খোশ মেজাজে। সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চের গণ কনভেনশনে দর্শকাসনে লক্ষ্মণ শেঠ। ছবি: সুমন বল্লভ।
অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এ বার সরাসরি দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন সিপিএমের বিক্ষুব্ধ নেতা লক্ষ্মণ শেঠ। নাম না-করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, রবীন দেব-সহ দলের গোটা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীকেই নিশানা করেছেন তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ। দলে গণতন্ত্রের বদলে এখন ব্যক্তিতন্ত্র চলছে এবং স্বৈরাচারী শাসনে ভাঁড়েদের সমাবেশ ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি! তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলাকালীন এমন সব মন্তব্য করে লক্ষ্মণবাবু গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে পড়লেন বলেই মনে করছে আলিমুদ্দিন।
বস্তুত, তমলুকে গিয়ে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তিন সদস্য লক্ষ্মণ-অনুগামীদের হাতে হেনস্থার শিকার হওয়ার পরেও পূর্ব মেদিনীপুরের এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করেনি আলিমুদ্দিন। লোকসভা ভোটের আগে ওই জেলায় লক্ষ্মণের প্রভাবের কথা ভেবে বরং ধীরে চলো নীতিই নিয়েছিল তারা। কিন্তু রবিবার প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে তোপ দেগে স্নায়ুর লড়াইয়ে প্রথম পলক ফেললেন লক্ষ্মণবাবুই! রাজ্য নেতৃত্বের হাতে তুলে দিলেন নতুন অস্ত্রও। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “প্রকাশ্যে দলকে হেয় করা অবশ্যই গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গ। তার জন্য দলের গঠনতন্ত্রে ধারাও আছে।” পূর্ব মেদিনীপুরে লক্ষ্মণবাবু ও তাঁর অনুগামীদের জড়িয়ে যে দু’টি তদন্ত এখন চলছে, তার বাইরে নতুন অভিযোগের ক্ষেত্রও এ দিন তৈরি হল বলে আলিমুদ্দিন সূত্রের ব্যাখ্যা। তবে এর পরেও কড়া ব্যবস্থা না-নিয়ে সিপিএম নেতৃত্বের একাংশ দেখতে চাইছেন, বেপরোয়া হয়ে আরও কী করেন লক্ষ্মণবাবু!
শেক্সপিয়রের ‘রাজা লিয়ার’ নাটকের
অন্যতম চরিত্র বিদূষক। রাজ্যপাট হারানোর পরও
রাজার সঙ্গে থেকে গিয়েছিল সে। রসিকতার মধ্যে
দিয়ে রাজাকে সমালোচনা করতেও ছাড়েনি। বিদূষকের
শেষ পর্যন্ত কী হল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কিন্তু
লিয়ারের ট্র্যাজিক পরিণতি ঠেকানো যায়নি।
তাঁর কর্মফলেই গোটা রাজ্য ছারখার হয়ে গিয়েছিল।
বিদূষক কেন, কেউই তা রুখতে পারেনি।
গত কয়েক দিন ধরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএমে তুলকালাম চললেও নিজে মুখ খোলেননি লক্ষ্মণবাবু। দলেরই আর এক বিক্ষুব্ধ নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার ডাকে সাড়া দিয়ে এ দিন সকালে তিনি এসেছিলেন রবীন্দ্র সদনে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চে’র গণ কনভেনশনে। সতর্ক রেজ্জাক অবশ্য লক্ষ্মণবাবুকে মঞ্চে তোলেননি। দর্শকাসনে বসেই অনুষ্ঠান শুনেছেন প্রাক্তন সাংসদ। অনগ্রসরদের ক্ষমতায়নের জন্য রেজ্জাকের তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন। এবং তারই ফাঁকে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তিনি দলের রাজ্য নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় তুলে অবিচারের অভিযোগ করেছেন।
লক্ষ্মণবাবুর দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অন্যান্য অভিযোগের তদন্তের কথা বাইরে বেরিয়ে গেলেও তাঁকে কিছু জানানোই হয়নি! এই ঘটনাকে দলের তরফে প্রচণ্ড শৃঙ্খলাভঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন তিনি। কিন্তু তার পরে তমলুকে দলের নেতাদের হেনস্থার ঘটনায় তাঁর দিকেই তো অভিযোগের আঙুল উঠছে? প্রশ্নের জবাবে লক্ষ্মণবাবুর বক্তব্য, “আমি তো কলকাতায়! কী করে জানব, ওখানে কী হয়েছে! তদন্ত হোক। তদন্তের আগেই যারা এ সব বলছে, তাদের উদ্দেশ্য সহজেই বোঝা যায়!” তা হলে কি ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি? লক্ষ্মণবাবুর জবাব, “সম্পাদকমণ্ডলী তাদের মতো কথা বলছে। দলে গণতন্ত্র না-থাকলে আমলাতন্ত্র, ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতা জন্ম নেয়। এটা অনিবার্য। যার জন্যই রাশিয়ার পতন হল। স্তালিনবাদ নস্যাৎ হয়ে গেল!” সিটুর পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকের আরও মন্তব্য, “তার পরে অতি-গণতন্ত্র নিয়ে আবির্ভাব হল গর্বাচেভের। নিজের দল নিজেই তুলে দিলেন!” এখানেই থামেননি লক্ষ্মণবাবু! আরও বলেছেন, “আসলে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি নেতৃত্ব দিলে তাকে ঘিরে ভাঁড়েদের সমাবেশ ঘটে! কিন্তু শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’কেও বিদূষকেরা বাঁচাতে পারেনি!”
তাঁদের দলে কে ‘কিং লিয়ার’? গর্বাচেভই বা কে? কারা ভাঁড়? দলে কি এখন স্বৈরতন্ত্র চলছে? লক্ষ্মণবাবু বলেছেন, “আপনারা বুঝে নিন!” তবে তিনি নাম না-করলেও যে ভাবে উপমা ব্যবহার করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএম সূত্রে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে কিং লিয়ার এবং গর্বাচেভ বলতে যথাক্রমে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু ও দলের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর বিদূষক রবীনবাবু-সহ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর অন্য নেতারা! রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে পূর্ব মেদিনীপুরের ভারপ্রাপ্ত রবীনবাবু এ দিন অবশ্য লক্ষ্মণবাবুর আক্রমণের জবাবে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আনুষ্ঠানিক ভাবে মন্তব্য করেননি দলের অন্য কোনও রাজ্য নেতা।
প্রকৃতপক্ষে, শুধু তমলুকে হেনস্থার ঘটনায় অভিযোগই নয়, দলে অবিচার আরও আগে থেকে চলছে বলে এ দিন পাল্টা অভিযোগ করেছেন লক্ষ্মণবাবু। দু’বছর আগে রাজ্য সম্মেলনে সিপিএমের রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়েছিলেন তিনি। নন্দীগ্রামের নিখোঁজ মামলায় তখন তিনি আত্মগোপনে। যোগ দেননি রাজ্য সম্মেলনে। লক্ষ্মণবাবুর বক্তব্য, দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য কমিটির নির্দেশিকা ছিল, যাঁরা আত্মগোপনে আছেন বা মিথ্যা মামলায় ফেঁসে আছেন, তাঁদের পদ থেকে সরানো যাবে না। অথচ তাঁর বেলায় সে নীতি মানা হয়নি! লক্ষ্মণবাবুর তির, “আমাদের দেশের ব্যবস্থাকে আমরা বুর্জোয়া ব্যবস্থা বলি। কিন্তু সেই দেশের বিচার ব্যবস্থাতেও তদন্তের আগেই কাউকে শাস্তি দেওয়া হয় না। এখানে (দলে) অগণতান্ত্রিক ভাবে যা করা হয়েছে, তা তার চেয়েও নিকৃষ্ট!”
এত ক্ষোভ যে দলের বিরুদ্ধে, সেই সিপিএমে কি আর থাকবেন? লক্ষ্মণবাবু বলেছেন, “দল ছাড়ব কি না, ভবিষ্যৎ বলবে। সদস্যপদ নবীকরণের এখনও সময় আছে।” লক্ষ্মণবাবু যেমন এই ভাবে দলের উপরে চাপ বাড়াচ্ছেন, সিপিএমও তেমনই তাঁকে শহিদ হওয়ার মওকা দিতে নারাজ! আলিমুদ্দিন বরং তাকিয়ে আছে সদস্যপদ নবীকরণের শেষ দিন ৩১ মার্চের দিকে। যাতে সাপও মরে, লাঠিও থাকে অক্ষত!