পরম্পরা অনুযায়ী, উত্তর কলকাতার জোড়াবাগানের দেওয়ালটার ‘অধিকার’ সিপিএমের উপরেই বর্তায়। চুনকামের তলায় এখনও হালকা পড়া যাচ্ছে, অমুক কমরেডকে ভোট দেওয়ার আবেদন। কিন্তু সেখানেই টিএমসি লিখে দেওয়া হয়েছে।
রবিবার সকালে পার্টির পোড়খাওয়া কমরেড গিয়ে শাসক দলের দুই তরুণ তুর্কিকে পেয়ে ‘ভাই, তোরা এটা কী করেছিস’ বলে অনুযোগ করলেন। ‘ভাই’টি সংবেদনশীল। বিরোধী দলের ‘দাদা’কে সান্ত্বনা দিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমাদের দু-একটা দেওয়ালের সঙ্গে তোমরা ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নিও।
গোটা পশ্চিমবঙ্গের ছবিটাই এমন কি না, এখনই বলা যাচ্ছে না! তবে উপরে-উপরে অন্তত এই ‘শেকহ্যান্ড’ আর ‘দাদা বলা’র মেজাজটাই এখনও পর্যন্ত বহাল। ভোটের দিনক্ষণ ও বেশির ভাগ প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরে এ ছিল প্রথম রবিবার! হাল্কা তরজা শুরু হলেও সেই ‘যুদ্ধং দেহি’ ঝাঁঝটা কিন্তু এখনও উধাও! দক্ষিণ কলকাতায় বিজয়গড় কলোনিতেও কোথাও কোথাও দেখা গেল, রীতিমতো ভাই-ভাই মুডে টিএমসি-সিপিএম। দেওয়াল-লিখনের সময়ে এক জনের রং ফুরিয়ে গেলে, অন্য জন ভরসা দিচ্ছে, চিন্তা করিস না, আমরা তো আছিই!
তবে এই শান্তিপূর্ণ, সদ্ভাবের বাতাবরণের আড়ালে চাপা ফোঁসফোঁসটা একেবারে নেই, তা বলা যায় না। যেমন, বাঁকুড়ায় বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্র। দেওয়ালে তৃণমূল প্রার্থী সৌমিত্র খানের নাম লেখা দেওয়ালের দিকে চেয়ে কিছুটা উদাস সিপিএমের পাত্রসায়র জোনাল কমিটির সম্পাদক লালমোহন গোস্বামী। “সব দেওয়ালই এখন ওদের! অবশ্য সংগঠনের ছেলেরাই যখন ঘরছাড়া, তখন দেওয়াল লিখতটাই বা কে!” ওই তল্লাটে ইন্দাসে বিক্ষিপ্ত কিছু দেওয়াল-লিখন হয়েছে সিপিএম প্রার্থী সুস্মিতা বাউড়ির নামে। কিন্তু তৃণমূল অনেকটাই এগিয়ে।
তবু শাসক দলের দেওয়াল-লিখনের দুর্বার গতিও কেমন ঢিমে মনে হচ্ছে যেন! অন্য বার এ রাজ্যে প্রার্থীর নাম ঘোষণা হওয়ামাত্রই বড় দলগুলোর অন্তত প্রচারের সব মাল-মশলা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াই দস্তুর। দক্ষিণ কলকাতার এক সিপিএম নেতা বলছেন, ‘সেই রাম বা অযোধ্যা কোনওটাই কী আছে!’ বাস্তবিক, এখন নির্বাচন কমিশনের যা কড়াকড়ি ও সাধারণ নাগরিকদের অনেকেরই যা প্রতিরোধ--- তাতে দেওয়াল-লিখনের চলটা খানিকটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে।
কলকাতা থেকে কোচবিহার--- সর্বত্র বাড়ছে দেওয়াল-লিখনের বিরুদ্ধে সচেতনতা। পার্কসার্কাসের কাছের পাড়া ওরিয়েন্ট রো-তালবাগানের বাসিন্দারা, কলকাতায় চার বছর আগের পুরভোট থেকেই দেওয়ালে আঁচড়টি পড়তে দিচ্ছেন না। রাজনৈতিক দলগুলো গাঁইগুঁই করেও তাঁদের জেদের কাছে হার মেনেছেন। কলকাতা (দক্ষিণ) কেন্দ্রের অন্তর্গত এলাকাটির স্থানীয় বাসিন্দা শাহানশাহ মির্জা এ বারও আত্মবিশ্বাসী: “দেখবেন, এ বারও আমাদের পাড়ায় বাড়ির দেওয়ালগুলো ঠিক ঝকঝক করবে।”
কোচবিহারের মাথাভাঙার ছবিটাও এ বার অনেকটা একই রকম। শাসক দলের কর্মীরা বাড়িতে ঢুকে দেওয়াল-লিখনের আবদার নিয়ে এলে, অতিথি-আপ্যায়নে কোনও ফাঁক থাকছে না। সাধারণ নাগরিকেরা অনেকেই রাজনৈতিক নেতাদের চা-বিস্কুট খাইয়ে সবিনয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছেন। গাঁটের পয়সা খরচা করে রং-করানো দেওয়ালে কিছুতেই কোনও আঁকিবুকি কাটতে দেবেন না।
আমজনতার এই মনোভাব বুঝে পিছু হটছে রাজনৈতিক দলগুলোও। কোচবিহারে স্থানীয় বিজেপি নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ যাত্রা দেওয়াল-লিখনের ছায়া মাড়ানো নয়! জেলার সাধারণ সম্পাদক নিখিল রঞ্জন দে-র কথায়, “ভোটারদের চটিয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারব নাকি! বরং ফ্লেক্স, ব্যানার, এসএমএসেই সামাল দেব!” কংগ্রেস নেতা শ্যামল চৌধুরীও বাধ্য হয়ে ফ্লেক্সের দিকে ঝুঁকছেন। ফরোয়ার্ড ব্লকের উদয়ন গুহও সরাসরি ভোটারের দরজায় হাজির হওয়ার সার্থকতার কথাই তুলে ধরছেন!
যা পরিস্থিতি, দেওয়াল-লিখনের ব্যাপারে তাই সব দলই কিছুটা ‘ধীরে-চলো’ নীতিতে। মানে, বাড়ির দেওয়াল চুনকাম করে সিপিএম বা তৃণমূল নিজেদের নাম লিখে রাখলেও খাতায়-কলমে গৃহস্থের অনুমতি হাতে আসা পর্যন্ত পুরোটা লিখতে সাহস পাচ্ছেন না। ঘাটালে ‘খোকাবাবু’ দেবের নাম বা মেদিনীপুরে সন্ধ্যা রায়ের নাম লিখতে শাসক দলের ছেলেপুলেরা উৎসাহে ফুটছেন। কিন্তু কমিশনের তোপের মুখে পড়ার ভয়ে মেজ-সেজ নেতাদের কখন-সখনও তাঁদের উৎসাহে লাগাম পড়াতে হচ্ছে। সবংয়ে যেমন, এখন ‘দীপক অধিকারী (দেব)’-এর নামে একটি দেওয়ালও লেখা হয়নি। দমে গিয়ে এক তৃণমূল সমর্থকের মন্তব্য, ‘ধুর, ধুর, এর থেকে গুরুর ছবি টাঙানোই ঢের ভাল! কিছু লিখতে হবে না, ওই হাসিটাই কাফি!’
আরও একটা কারণ ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের। দোল! দক্ষিণ কলকাতায় তৃণমূলের পুরনেতা তপন দাশগুপ্ত এখনই সব দেওয়াল লিখে ফেলার পক্ষপাতী নন। বলছেন, আমরা তো আবার একটু বসন্ত উৎসব করি! দেওয়ালে বসন্তের রং ধরলে সব লেখার দফারফা! বিকেল পর্যন্ত ভাত না-খেয়ে দেওয়াল-লেখার তদারকি করলেও উত্তর কলকাতায় সিপিএমের অজয় সাহা মজেছেন ফেসবুকের ‘দেওয়াল’ নিয়েও। স্মার্টফোন হাতে জনে-জনে ডেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অণ্ণা হজারেকে নিয়ে নিজের পোস্ট করা কার্টুন দেখাচ্ছেন।
একটা ব্যাপারে, প্রতিপক্ষরা সবাই একমত। তৃণমূলের অরূপ বিশ্বাস বা সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী দু’জনেই বলছেন, এটা নতুন যুগ! দেওয়াল-লিখনের হাতিয়ার যেমন আছে, ফ্লেক্স-ব্যানার-পোস্টার-রোড-শো থেকে সাইবার-প্রচার কোথাওই কাউকে জমি ছাড়া যাবে না।