বিশিষ্টজনেদের সভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শনিবার বিদ্যামন্দির অডিটোরিয়ামে। —নিজস্ব চিত্র
সঙ্কটের সময়ে এ বার শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের কাছে সরাসরিই সমর্থন চাইলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিশিষ্টজনদের কাছে তাঁর আবেদন, “একটা অশুভ হাত সংস্কৃতির জগতে অনুভব করছি। অতীতে এটা ছিল না। একটা সর্বাত্মক ঐক্য চাই এখন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিদ্যা জগতের সকলকে এক হয়ে এখন এই অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে।”
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সর্বাত্মক ঐক্যের আর্জি জানালেও রাজ্যের সাংস্কৃতিক মহলে শিবির বিভাজন এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। সাহিত্য, খেলা থেকে শুরু করে অভিনয় জগতের একের পর এক নক্ষত্র নানা কারণে শাসক শিবিরে অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছেন নিজেদের। বিদ্যামন্দির অডিটোরিয়ামে শনিবার সন্ধ্যায় বুদ্ধবাবুর সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি, নাট্য জগতের মুখোমুখি আসরেও যেন এসে পড়েছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিরই ছায়া।
তিন বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনের মুখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর এমন আসরে তারকা সমাবেশ ছিল অনেক বেশি। পরিবর্তনের হাওয়া প্রবল হলেও তখনও বামফ্রন্ট সরকার আছে। সে দিন যাঁরা তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে হাজির ছিলেন, এ দিন স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের অনেকে অনুপস্থিত। যাঁরা এসেছিলেন, প্রবল তৃণমূল-দাপটেও তাঁরা বাম দিক ছাড়েননি। তবে গত বারের মতো প্রশ্নোত্তরের পর্ব না-থাকায় বুদ্ধবাবুর জন্য কিছু প্রশ্ন মনে রেখেও উত্তরের সুযোগ না পেয়ে হতাশ তাঁদের একাংশ!
এমন আসরে নক্ষত্র তালিকায় অবশ্যই এক নম্বর হতে পারতেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সশরীরে আসতে না-পেরে চিঠি মারফত শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি। আগে থেকেই শু্যটিং-এর ডেট ঠিক থাকায় আসতে পারলেন না বলে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। চিঠি পাঠিয়েই আফশোস করেছেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তিনি জানিয়েছেন, বাংলার সাংস্কৃতিক চেতনা এখন বিপর্যস্ত এবং বিপন্ন। এই সময়ে এই আসরে তাঁর কিছু শোনার এবং অবশ্যই বলার ছিল। কিন্তু শহরের বাইরে থাকায় সে আর হয়ে উঠল না। নাট্য-জগতের শোভা সেন চিঠিতেই পরিষ্কার লিখেছেন, ‘বামপন্থা ছাড়া অন্য কোনও পন্থা আমি জানি না, মানিও না’! চিঠি পাঠিয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতির বাইরে যাঁরা এসেছিলেন, সেই তরুণ মজুমদার, আবুল বাশার, অশোকনাথ বসু, চিত্রা সেন, পবিত্র সরকার, নাট্যকার ও অভিনেতা দুই চন্দন সেন, অশোক মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণ ধর, শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়, ওয়াসিম কপূর, জ্যোতির্ময়ী সিকদার, হাসিম আব্দুল হালিম প্রমুখ এঁদের কারও উপস্থিতিতেই কোনও চমক নেই! তরুণ প্রজন্মের অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন বাদশা মৈত্র।
‘কোনও ভূমিকা না-করেই বলছি’ বলে বুদ্ধবাবুও সরাসরি লোকসভা ভোটে তাঁদের আহ্বানের কথাই বিশিষ্ট জনেদের শুনিয়েছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক বিজেপি-র থেকে সমদূরত্ব রেখে তৃতীয় বিকল্প গড়ার চেনা আবেদনই জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক নাট্যকারের কথায়, “সুযোগ পেলে এর পরে বুদ্ধবাবুকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম, এই দু’টোর মধ্যে তুলনায় কম বিপদ কোনটা? উত্তর নিশ্চয়ই ওঁর কাছে পাওয়া যেত। কিন্তু সুযোগ হল না!”
তবে আসরের গাম্ভীর্য বুঝেই বিষয়বস্তু এক হলেও রাজনৈতিক সমাবেশের চেয়ে বক্তব্যের মেজাজ একটু পাল্টে নিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। কংগ্রেসের হাতে ১০ বছর দেশের অর্থনীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, “এখন দেখছি অন্ধকার, ধোঁয়ায় ভরা রাস্তায় একা একা হাঁটছেন মনমোহন সিংহ! রাস্তা ভাঙাচোরা। পিছনে তাড়া করছে ক্ষুধা! যা চেয়েছিলেন, তা হয়নি।” আবার বিজেপি-র উত্থানের বিপদ বোঝাতে বলেছেন, “এক রাস্তা দিয়ে মনমোহন একা চলে যাচ্ছেন। আর একটা রাস্তা দিয়ে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে রে রে করে তেড়ে আসছেন নরেন্দ্র মোদী! তাঁর জন্য আরএসএস এবং কর্পোরেট জগৎ এক হয়েছে!” এই দুই পথকেই তাঁরা পরাস্ত করতে চান বলে জানিয়েছেন বুদ্ধবাবু।
রাজ্যের পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে টেনে এনেছেন টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র জগতের কথা। অভিযোগ করেছেন, কালো টাকা আগেও ছিল। কিন্তু এখন নতুন চেহারা নিয়েছে। বুদ্ধবাবুর কথায়, “চিট ফান্ড অনেক সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার সিনেমা জগতকেও কলুষিত করছে। টালিগঞ্জ পাড়ার অনেকে কালো টাকার কাছে মাথা নিচু করছে।” যা শুনে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, তদন্তকারীদের উচিত বুদ্ধবাবুর কাছ থেকেই কালো টাকার হদিস জেনে নেওয়া!
তবে তাঁর চেনা জগতের কাছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে সব চেয়ে বিষণ্ণ দেখিয়েছে, যখন রাজ্যের শিল্পায়নের জন্য তাঁর চেষ্টা এবং বর্তমানের বেহাল দশার কথা বলেছেন। বুদ্ধবাবুর কথায়, “এই জায়গাটা দিন-রাত্তির তাড়া করে আমাকে! কী হল! এটা তো সিপিএম বনাম তৃণমূল না! যাঁরা পড়াশোনা শেষ করছেন, তাঁরা কি সবাই মুম্বই, বেঙ্গালুরু গিয়ে চাকরি পাবে?”
প্রশ্নটা আসলে রেখে গেলেন উত্তরসূরির জন্য!