কামদুনিতে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল ঠিক ২৮৮ দিন আগে। বারাসতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলাটির শুনানি এখনও শেষ হয়নি। অথচ ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং কামদুনিতে গিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন, এক মাসের মধ্যে বিচার শেষ করে দোষীদের চরমতম সাজা দেওয়া হবে।
শুধু কামদুনিই বা কেন? সাড়া জাগানো পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণের দু’বছর বাদে দেখা যাচ্ছে, শাস্তি দূরস্থান, মূল দুই অভিযুক্ত ধরাই পড়েনি। কাটোয়া গণধর্ষণ-মামলার হাল তথৈবচ। দু’বছর গড়িয়ে গেলেও তা আটকে আছে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে, এক জন অভিযুক্ত এখনও নাগালের বাইরে। আবার মধ্যমগ্রামের এক কিশোরীকে উপর্যুপরি গণধর্ষণের যে অভিযোগ ঘিরে রাজ্য তোলপাড় হয়েছে, পাঁচ মাস বাদে বারাসত কোর্টে সেই মামলার চার্জগঠন হয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ সবে শুরু হয়েছে।
ইতিমধ্যে মধ্যমগ্রামের ধর্ষিতা মেয়েটির অপমৃত্যু ঘটেছে। আর পার্ক স্ট্রিট ও কাটোয়ার দুই নির্যাতিতা জানেন না, মুম্বইয়ের দুই তরুণীর মতো তাঁরা কবে সুবিচার পাবেন। “জানি না, বিচারে কেন দেরি হচ্ছে। বিচার তাড়াতাড়ি শেষ হবে, এই আশা ছাড়া কী-ই বা করতে পারি!” শুক্রবার বলেন পার্ক স্ট্রিটের নির্যাতিতা। কাটোয়ার মহিলা অবশ্য হতাশ। তাঁর আক্ষেপ, “সুবিচার না-পেলে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারছি না।” দু’বছর আগে তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে মেয়ের সামনেই গণধর্ষণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। “আমার মেয়েকে কেউ কিছু বলবে না তো!” আশঙ্কা ঝরে পড়ে তাঁর গলায়।
কিন্তু মহারাষ্ট্র তো সাড়ে সাত মাসের মধ্যে গণধর্ষণের অপরাধের বিচার সেরে ফেলতে পারল! পশ্চিমবঙ্গ পারছে না কেন?
বস্তুত এ দিন কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসে এক মামলার শুনানির সময়ে এর একটা কারণ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট থেকে বদলি হওয়া বিচারকেরা মামলাটি দায়ের করেছেন। অভিযোগ, অন্য কোর্টে বদলি হওয়ায় তাঁরা পেশাগত ভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। আবেদনকারীদের কৌঁসুলি হিসেবে সওয়াল করতে গিয়ে অর্জুন রায় মুখোপাধ্যায়, প্রতীক ধরেরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তিন বছর আগে নতুন সরকার শাসনক্ষমতায় আসার সময়ে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের সংখ্যা ছিল ১৫৩। এখন কমে হয়েছে ৪৫। তারও প্রায় আটটিকে মহিলা আদালত, শিশু শ্রমিক আদালত ইত্যাদি নাম দিয়ে বদলে দেওয়া হয়েছে।
পরিণামে গুরুত্বপূর্ণ বহু মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে বলে আইনজীবী মহলের একাংশের অভিযোগ। যদিও রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এই পরিসংখ্যান মানেন না। তাঁর দাবি: পশ্চিমবঙ্গে এখন ৮৮টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু রয়েছে, যার ৪৬টিতে শুধুমাত্র নারী নির্যাতনের মামলা হয়। রাজ্য সরকার নারী নিগ্রহের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে এই দাবি করলেও চন্দ্রিমাদেবী অবশ্য বিচারের গতি ত্বরান্বিত করে তোলার ব্যাপারে নির্দিষ্ট আশ্বাস দিতে পারেননি। বরং আইনমন্ত্রীর মন্তব্য, “ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে সব ধর্ষণের মামলা দ্রুত শেষ হবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। অনেক কারণেই দেরি হতে পারে।”
দেখে নেওয়া যাক, পার্ক স্ট্রিট-কামদুনি-কাটোয়ার মতো ধর্ষণ-মামলার শুনানি কী ভাবে চলছে।
কাটোয়া ধর্ষণ-মামলার চার্জশিট ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে জমা দেওয়ার পরে চার্জ গঠন করতেই পেরিয়ে গিয়েছে এক বছর। আদালত-সূত্রের খবর, পুলিশ চার্জশিট পেশ করেছিল ২০১২-র ৩০ মে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয় ২০১৩-র ২৮ মে। তার পরেও প্রায় দশ মাস গড়াতে চলল, এখনও সাক্ষ্যগ্রহণের পালা চলছে। ট্রেনের যাত্রী, পুলিশ, চিকিৎসক ও ফরেন্সিক-বিশেষজ্ঞ মিলিয়ে কাটোয়া-মামলায় সাক্ষী ৪৮ জন। এ পর্যন্ত ৩০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এত দেরি কেন?
পুলিশের ব্যাখ্যা: এমনিতেই চার্জ গঠনের দু’মাস বাদে শুনানি শুরু হয়। তা ছাড়া বিচারক বিভিন্ন সময়ে ছুটিতে ছিলেন। উপরন্তু ডিসেম্বরে বিচারকের বদলির নির্দেশ আসায় তিনি দু’মাস সাক্ষ্যগ্রহণ করেননি। কাটোয়া মামলার সরকারি আইনজীবী কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রতিটি সাক্ষীকে আদালতে হাজির করাতে হচ্ছে। বারবার সমন দিয়ে ওঁদের ডেকে পাঠাচ্ছি।” আগামী ৩১ মার্চ মামলাটির পঞ্চম দফার শুনানি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্য দিকে পার্ক স্ট্রিট-মামলা চলছে কলকাতার বিচারভবনের প্রথম ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। সেখানে এতটাই চাপ যে, মাসে মাত্র দু’বার মামলাটির শুনানি হচ্ছে। এই হারে এগোলে কবে শুনানি শেষ হবে, সরকারি আইনজীবী তা জানাতে পারেননি। আবার কামদুনি গণধর্ষণ মামলা রয়েছে কলকাতার অতিরিক্ত দ্বিতীয় জেলা ও দায়রা বিচারকের এজলাসে। শুনানি হচ্ছে মাসে ছ’দিন। তুলনায় মধ্যমগ্রামের গণধর্ষণ ও ধর্ষিতার অপমৃত্যুর মামলা কিছুটা সচল। পাঁচ মাসের মধ্যে সেখানে চার্জ গঠন হয়ে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্ব চালু হয়েছে।
ধর্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার এ হেন শ্লথগতি সম্পর্কে আইনজীবী মহল কী বলছে?
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের মতে, এ রাজ্যে বিচারপতি ও বিচারকের সংখ্যা দ্রুত কমেছে, তার উপরে অনেক ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট তুলে দেওয়া হয়েছে। যে ক’টা রয়েছে, সেখানে মামলার পাহাড় জমছে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক অসহযোগিতাকেও দায়ী করছেন তিনি। “সাক্ষী জোগাড় করাটা পুরোপুরি পুলিশের দায়িত্ব। অথচ অনেক সময়ে পুলিশ সে ব্যাপারে তৎপর হচ্ছে না।” অভিযোগ অরুণাভবাবুর।
পাশাপাশি কর্মসংস্কৃতির ঢিলেমির দিকেও আঙুল উঠছে। আইনজীবীদেরই কারও কারও দাবি: এ রাজ্যে বিভিন্ন কারণে হুটহাট ছুটির যে রেওয়াজ, বিচার-প্রক্রিয়ায় তার কুপ্রভাব পড়ছে। আইনজীবীর মৃত্যুতে খাস হাইকোর্টেও এক দিন কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এমন আচমকা ছুটির দরুণ এক-একটা মামলা ফের উঠতে উঠতে অনেক সময় বছর পেরিয়ে যায়। এক আইনজীবীর কথায়, “সুপ্রিম কোর্টে তো বটেই, অন্য কিছু রাজ্যেও এ ধরনের ছুটির প্রথা নেই। আইনজীবীদের প্রয়াণে শোক প্রকাশের জন্য সেখানে বছরে একটা দিন রাখা হয়। আদালতের কাজ বন্ধ হয় না।” এ জাতীয় ছুটির রেওয়াজে বিচার-প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার যুক্তি অরুণাভবাবু অবশ্য মানতে চাননি।
এ তো গেল আইনজীবীদের মতামত। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের হাল নিয়ে রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য?
আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমাদেবী বলেন, “এটা আমার দফতরের আওতায় পড়ে না। এগুলো স্বরাষ্ট্র দফতরের মামলা।” যদিও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কোনও মামলা কোর্টে গেলে তার দেখভালের দায়িত্ব ডিরেক্টর অব প্রসিকিউশনের হাতে চলে যায়, যা কি না আইন দফতরেরই অধীনে। স্বরাষ্ট্র-সচিবের দাবি: ধর্ষণের মামলাগুলোয় যখন যেমন তথ্য চাওয়া হয়েছে, সরকারের তরফে সব জোগানো হয়েছে। তাঁর যুক্তি, “দ্রুত নিষ্পত্তি আমরাও চাই। কিন্তু রায় তো দেন বিচারক! এ নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।” আর চন্দ্রিমাদেবীর মন্তব্য, “বিলম্বের জন্য সরকারের গাফিলতির অভিযোগ নেই। তবু কেন দেরি হচ্ছে, বিস্তারিত না-জেনে বলা যাবে না।” তবে কারণগুলো কী কী হতে পারে, আইনমন্ত্রী তাঁর ইঙ্গিতও দিয়েছেন। “হতে পারে, কেউ সাক্ষ্য দিতে দেরি করছেন। অথবা অন্য কোনও কারণে সময় লেগে যাচ্ছে!” জানাচ্ছেন চন্দ্রিমাদেবী। তিনি এ-ও বলছেন, “মুম্বই মুম্বই করে লাফিয়ে লাভ নেই। এ রাজ্যেও বালুরঘাট, মেদিনীপুর ও আর একটা ধর্ষণের মামলায় তিন থেকে ছ’মাসের মধ্যে সাজা ঘোষণা হয়েছে। তাই এখানে হয় না, এ অভিযোগ ঠিক নয়।”