রাজ্যে প্রতি দিনই তাদের লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে। শাসক দলের বিরোধিতায় প্রায় রোজই উঠে আসছে নতুন নতুন উপাদান। তবু এ কাজ করতে গিয়ে বিজেপি-র বিপদকে যাতে ছোট করে দেখা না হয়, তার জন্য সতর্ক হচ্ছে সিপিএম। তৃণমূল এবং বিজেপি-কে জোড়া নিশানায় রেখেই প্রচার কৌশল সাজাতে চাইছে আলিমুদ্দিন। আসন্ন সম্মেলন-পর্বের আগেই দলে এই ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পলিটব্যুরোর সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
লোকসভা ভোটে এ বার রাজ্যে দু’টি আসন এবং প্রায় ১৭% ভোট পেয়েছিল বিজেপি। তার পরে সারদা-সহ আরও নানা প্রশ্নে প্রবল তৃণমূল-বিরোধী প্রচারের আবহেও পুজোর আগে দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে শোচনীয় ফল হয়েছে সিপিএমের। বিজেপি-ই বরং তৃণমূলকে টেক্কা দিয়ে একটি বিধানসভা আসন জিতে নিয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে আলিমুদ্দিনের মত, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ থেকেই ভোট ভাগাভাগি হচ্ছে তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে। কিন্তু একই সঙ্গে বুদ্ধবাবুর মতো শীর্ষ নেতাদের অভিমত, রাজ্যে শাসক দল বলেই তৃণমূল বেশি করে নিশানায় চলে আসছে। বিজেপি-র বিরুদ্ধে প্রচারে কোথাও কোথাও এখনও শিথিলতা থেকে যাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে আরও ক্ষতি হবে আশঙ্কা করেই বিজেপি-বিরোধিতায় কোনও ঢিলেমি না দেখানোর জন্য দলকে বার্তা দিয়েছেন বুদ্ধবাবু। দলের অন্দরে তাঁর সাফকথা, তৃণমূলের ‘অসভ্যতা’র বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপি-কে ছেড়ে কথা বলা চলবে না!
শুধু বার্তা দেওয়াই নয়, বিজেপি-কে একই ভাবে নিশানা করার লাইন কার্যকর করার জন্য সক্রিয়তাও দেখাচ্ছেন বুদ্ধবাবু। হিমাচল প্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে ঘিরে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছিল বীরভদ্র সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে। শিমলার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন যথেষ্ট সক্রিয়। পুলিশি আচরণের প্রতিবাদে পুজোর ঠিক আগেই শিমলায় যৌথ প্রতিবাদ-সভায় বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত ছিলেন এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক তথা সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই সভায় সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র প্রতিনিধিরাও থাকবেন জেনে প্রথমে আপত্তি তোলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। একই মত জানান বুদ্ধবাবুও। ঋতব্রত শেষ পর্যন্ত ওখানে যাননি। দলে বুদ্ধবাবু বলেছেন, হিমাচল বা অন্য কোথাও কংগ্রেস কোনও অন্যায় করলে বামেরা নিজেরাই তার প্রতিবাদ করতে পারবে। সে জন্য বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের কোনও সংগঠনের সঙ্গে যৌথ মঞ্চে যাওয়ার দরকার নেই। ভাল করে খোঁজখবর না নিয়ে কোথাও এমন ধরনের কর্মসূচিতে যাতে সাড়া দেওয়া না হয়, তার জন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছেও সতর্ক-বার্তা পাঠিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
লোকসভা এবং তার পরে বিধানসভা উপনির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার পরে ২০১৬-য় চোখ রেখে পশ্চিমবঙ্গে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপাচ্ছে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক বক্তৃতাও তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বুদ্ধবাবুদের যুক্তি, এ রাজ্যে দীর্ঘ বাম শাসনে আরএসএসের বহু শাখা পর্যায়ক্রমে গুটিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাম জমানার অবসানের পরে গত তিন বছরে তারা আবার বাংলায়মাথা তুলেছে! শুধু দক্ষিণবঙ্গেই সঙ্ঘের এখন প্রায় ১১০০ শাখা কাজ করছে। বুদ্ধবাবুর যুক্তি, এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় এক দিকে বিজেপি-বিরোধী প্রচারের তীব্রতা বাড়াতেহবে, সব ধরনের মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তেমনই ধারাবাহিক আন্দোলনের পথেথেকে দলের দৃশ্যমানতাও বাড়াতে হবে। নইলে রাজ্যে বিরোধীরাজনীতির পরিসর চলে যাবে সেই বিজেপি-র দিকেই!
এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েই চলতি মাসের শেষ দিকে শুরু হতে যাচ্ছে এ রাজ্যে সিপিএমের তৃণমূল স্তরের সম্মেলন। জেলা সম্মেলনের প্রক্রিয়া চলবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তার পরে মার্চে রাজ্য সম্মেলন এবং এপ্রিলে বিশাখাপত্তনমে পার্টি কংগ্রেস। শারীরিক কারণেই বুদ্ধবাবুর পক্ষে কত জেলা সম্মেলনে যাওয়া সম্ভব হবে, তার সূচি এখনও ঠিক হয়নি। কিন্তু সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব চাইছেন, সংগঠনের ঝাড়াই-বাছাইয়ের পাশাপাশি সম্মেলন-প্রক্রিয়ায় দলের কর্মীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ুক। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “তৃণমূল যা করছে, কোনও চিন্তাশীল মানুষই মেনে নেবেন না! কিন্তু তার উল্টো দিকে বিজেপি-র উত্থানও বিরাট বিপদ। শুধু আমাদের নয়, রাজ্যের জন্যও।”