নিজের বাড়িতে কিসওয়ার জহান। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
সাত বছর আগে যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, ঠিক সেখানেই যেন ফিরে এসেছেন তাঁরা। তা বলে ঠিক এখনই নতুন আন্দোলনের স্বপ্ন দানা বাঁধছে না।
রিজওয়ানুর রহমান-কাণ্ডের পরিণতিতে কষ্ট পেলেও এখনই ফের পথে নামার কথা ভাবছে না কলকাতা। সাত বছর আগে রাজনীতির পতাকাবিহীন এই নাগরিক আন্দোলনের চাপেই লালবাজারের শীর্ষ স্তরের কর্তাদেরও সরাতে বাধ্য হয় তৎকালীন বাম সরকার। ভিন্ ধর্মের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে প্রিয়ঙ্কা তোদীকে বিয়ের পরে রিজের উপরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি এবং জুলুমের অভিযোগে ওই পুলিশকর্তারা অপসারিত হন। আদালতের নির্দেশে রিজের অপমৃত্যুর তদন্ত সিবিআই-এর উপরে ন্যস্ত হতেই সাময়িক যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করেন প্রতিবাদীরা।
তখন যাঁদের সরানো হয়েছিল, তাঁদের অন্যতম আইপিএস-কর্তা জ্ঞানবন্ত সিংহকে (তৎকালীন ডিসি, সদর) এ বার ফের গুরুত্ব দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে বর্তমান তৃণমূল সরকার। এখনকার এই শাসক দলই তখন রিজকে নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। রিজওয়ানুরের দাদা রুকবানুর রহমানও সেই দলেরই বিধায়ক। তা সত্ত্বেও জ্ঞানবন্ত সিংহকে প্রশাসনের মূলস্রোতে ডিআইজি (মুর্শিদাবাদ রেঞ্জ) হিসেবে ফিরিয়ে আনায় বিস্মিত নাগরিক-সমাজের একাংশ। তাঁদের মতে, “নৈতিক কারণেই জ্ঞানবন্তকে ফের এতটা সক্রিয় ভাবে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত না করলে পারত বর্তমান সরকার। রিজের প্রতি সামান্য সহৃদয়তা থাকলে এটা করা যায় না!”
তা বলে নতুন করে আন্দোলনের কথা তাঁরা কেউই ভাবছেন না। কেউ চরম হতাশাগ্রস্ত, কারও কারও বা আক্ষেপ, শুভবুদ্ধিসম্পন্নেরা এখন একজোট হতে পারছেন না।
বুধবার সেটাই বলছিলেন শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল। তাঁর কথায়, “এই সরকারের স্বভাবই অপরাধীদের রক্ষা করা। এরা কোনও দিনই ইনসাফ করবে না। কিন্তু এখনও শুভবোধসম্পন্ন প্রতিবাদীরা পুরোপুরি একজোট হতে পারছেন না।” রিজের ঘটনা নিয়ে প্রথমে সাধারণ নাগরিকেরা মাঠে নামলেও ক্রমশ রিজের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে মাঠে নামে তৎকালীন বিরোধী দল। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও রাজপথে নেমেছেন। তিলজলা লেনে রিজের পাড়ায় বারবার সভা করেছেন, বহু বার তাঁর বাড়িতে গিয়েছেন। কিন্তু সেই সময়ে মমতার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গ ছেড়েছেন। আবার কেউ কেউ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত থাকার দরুণ মুখে কুলুপ আঁটছেন।
সে দিনের প্রতিবাদী নাট্যকর্মী, আজকে রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু বা দিল্লিতে সাংসদ অর্পিতা ঘোষ যেমন সংবাদমাধ্যমের সামনে এই বিষয়টি নিয়ে পারতপক্ষে কিছু বলতে চাননি। আবার সেই সময়ে রিজকে নিয়ে আন্দোলনে মমতার প্রথম সারির সহযোদ্ধা, সদ্য মেয়াদ পার হওয়া সাংসদ কবীর সুমনও বর্তমানে এ রাজ্যের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম নিয়ে খুবই ‘তিক্ত’। তাঁর কথায়, “এ রাজ্যে যা ঘটে চলেছে তা নিয়ে কিছু বলতে প্রবৃত্তি হয় না।” রিজ-কাণ্ডের তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ অফিসার অরিন্দম মান্নার রহস্যজনক মৃত্যু নিয়েও রাজ্যে প্রতিবাদ না হওয়াটা লজ্জার বলেও সুমনের অভিমত।
ফলে, প্রশ্ন উঠছে রাজ্যে নাগরিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়েই। রিজের শুভানুধ্যায়ী বা আত্মীয়দেরও হতাশা গ্রাস করছে। স্বয়ং রিজের কাকা আকিলুর রহমান বলছেন, “২০১১ সালের ভোটে রিজওয়ানুরের ঘটনা ইস্যু ছিল। কিন্তু কী হল তাতে? এখন বুঝতে পারছি, আজকের সরকারি দল বিরোধী থাকাকালীন আমাদের মিথ্যে আশা দিয়েছিল।” একটি মাল্টিমিডিয়া সংস্থায় রিজের সহকর্মী সুজয় ঘোষ বা স্বপ্নিল সেনগুপ্তরাও মনে করছেন, জ্ঞানবন্তকে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্তে রিজকে নিয়ে আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠোকা হল।
তবে সমাজকর্মীরা কেউ কেউ এখনই হাল ছাড়তে নারাজ। রিজের মৃত্যুর সাত দিন পরেই পার্ক স্ট্রিটে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সামনে একনাগাড়ে অবস্থান বিক্ষোভে নেমেছিল কলকাতার বিভিন্ন স্তরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, সেই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা দোলন গঙ্গোপাধ্যায়েরও মত, “জ্ঞানবন্তকে এ ভাবে ফিরিয়ে আনায় বোঝা যাচ্ছে, তখনকার বিরোধীরা আসলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে নেমেছিল।” তাহলে এ বার শাসকের বিরুদ্ধে কেন মাঠে নামছেন না তাঁরা?
দোলনদেবীর অবশ্য বক্তব্য, “শুধু রিজ-কাণ্ডের পরিণতিই নয়, আরও অনেক ঘটনায় রাজ্যে গণতন্ত্র আক্রান্ত হচ্ছে। তাই নিয়ে আন্দোলনও চলছে। ভবিষ্যতে রিজের ঘটনাটি নিয়েও ফের আন্দোলন হতে পারে।”
রিজের বৃদ্ধা অসুস্থ মা কিসওয়ার জহান এ দিনও তিলজলা লেনের বাড়িতে বলেছেন, এখনও ইনসাফের আশায় বেঁচে আছি। কিন্তু রিজের কাকা আকিলুরেরই কটাক্ষ, রিজের নিজের লোকেরাই পদের মোহে আন্দোলন ভুলে গিয়েছেন। যাঁকে লক্ষ্য করে এই মন্তব্য, রিজের দাদা নদিয়ার চোপড়ার বিধায়ক রুকবানুর রহমান অবশ্য অবিচলিত। তিনি বলছেন, “ভাই (রিজওয়ানুর) ভাইয়ের জায়গায় আছে, কিন্তু সরকারের অংশ হিসেবে আমি রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থও দেখব। জ্ঞানবন্তকে রাজ্য সরকার দরকারমাফিক প্রশাসনে ঠিকঠাক ব্যবহার করলে ক্ষতি কী?”
সাত বছরে তবে অনেক কিছুই পাল্টে যায়।