নামী স্কুলে ভর্তি চাই, ইংরেজি জ্বরে বাবা-মা ফের ছাত্র

উৎপল দত্তের সেই ফিল্মি সংলাপে আজও পেটে খিল ধরে যায় বাঙালির। আমি দেশের মুখ উজ্জ্বল করব-র ইঙ্গানুবাদ, আই উইল বার্ন দি ফেস অব দি কান্ট্রি! ব্রিটিশ আমলে রায়বাহাদুর হওয়ার আশায় নিজেকে ‘ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ প্রমাণ করতে মরিয়া এক নেটিভ জমিদার। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে নিজের বেয়াইমশাইয়ের পরিচয় করানোর অননুকরণীয় ভঙ্গি: “দিস ইজ মাই ফাদার-ইন-ল’জ সান” বলে সামলে নিয়ে, “সান্স ফাদার-ইন-ল”!

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৪ ০৩:২৭
Share:

রামধনু ছবির একটি দৃশ্য।

উৎপল দত্তের সেই ফিল্মি সংলাপে আজও পেটে খিল ধরে যায় বাঙালির। আমি দেশের মুখ উজ্জ্বল করব-র ইঙ্গানুবাদ, আই উইল বার্ন দি ফেস অব দি কান্ট্রি!

Advertisement

ব্রিটিশ আমলে রায়বাহাদুর হওয়ার আশায় নিজেকে ‘ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ প্রমাণ করতে মরিয়া এক নেটিভ জমিদার। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে নিজের বেয়াইমশাইয়ের পরিচয় করানোর অননুকরণীয় ভঙ্গি: “দিস ইজ মাই ফাদার-ইন-ল’জ সান” বলে সামলে নিয়ে, “সান্স ফাদার-ইন-ল”!

চার দশক আগের হিট ছবি তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর দৃশ্য।

Advertisement

কাট টু ২০১৪। এ বার সেলুলয়েডে পুত্র গোগোলকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে মরিয়া দম্পতি মিতালি (গার্গী রায়চৌধুরী) ও লাল্টু (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)। স্কুলে অভিভাবকদের ‘ইন্টারভিউ’-পর্বে বাংলা মাধ্যম তারাসুন্দরী মেমোরিয়াল স্কুল থেকে পাশ মিতালি কায়দা করে বলেন, তাঁর স্কুলের নাম টিএসএম। আর ওষুধ ব্যবসায়ী লাল্টু কাঁচুমাচু হয়ে ‘আই ফাদার’ বলে নিজের পরিচয় দেবেন। ইন্টারভিউ দিতে পৌঁছতে দেরির কারণ ব্যাখ্যা করে তাঁর ফিরিস্তি, “সো জ্যাম, সো জ্যাম, বাইক পার্কিং লং টাইম, ছোট গলি!”

ছবির নাম ‘রামধনু’। বাঙালির ভুল ইংরেজি নিয়ে এমন হাসি-মস্করা যুগ যুগ ধরে বাংলা ছবিতে উঠে আসছে। তবে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবির মিতালি-লাল্টু-গোগোলদের গল্পটা মোটেও হাসির নয়। নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে মা-বাবাদের উৎকণ্ঠা বা যুদ্ধের কাহিনিই এ বার সেলুলয়েডে।

অনেকেরই মত, বাম আমলে কয়েক দশক এ রাজ্যে স্কুলস্তরে ইংরেজি-চর্চায় খামতির ফলে কয়েকটি প্রজন্ম বিস্তর ভুগেছে। কাজের বা উচ্চশিক্ষার জগতে ইংরেজি বলতে-বুঝতে নিজেরা ঠোক্কর খাওয়ার ফলেই ছেলেমেয়ের ইংরেজি স্কুলে সুযোগ পাওয়াটা তাঁদের কাছে মোক্ষলাভের সমান! এই পটভূমিটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সুযোগের জন্য এক ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন চাহিদা তৈরি হয়েছে।”

“হাব-ভাব দেখে মনে হয়, স্কুলে ভর্তির পরীক্ষাটা মা-বাবারই!”--- বলছিলেন দক্ষিণ কলকাতার হাজরা এলাকার একটি ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শেখার সংস্থার ডিরেক্টর শৈলা জাস্সি। তাঁর কথায়, “বাচ্চাকে কনভেন্ট বা নামী ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে চান কি পড়াচ্ছেন এমন মা-বাবা, বিশেষত মায়েরা ঝাঁকে ঝাঁকে ইংরেজি বলা শিখতে আসেন।” স্পোকেন ইংলিশ স্কুলেও অনেক শিক্ষার্থী-দম্পতির চাহিদা, বাচ্চাকে ভর্তি করানোর ইন্টারভিউ-এর উপযোগী ইংরেজি বুলি ও কেতা শিখিয়ে দিন।

নামী স্কুলে ভর্তির চৌকাঠ হিসেবে আজকের কলকাতায় উঠে এসেছে অগুন্তি ‘প্রি-স্কুল’ বা ‘প্লে স্কুল’। হাল্কা পড়াশোনা, খেলাধুলোর মধ্যে শুধু বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া, ক্লাসে বসায় ধাতস্থ করাই নয়, মা-বাবাদের ইন্টারভিউ-এর তালিম দেওয়াও এই ধরনের সংস্থাগুলির দায়। তেমনই একটি প্রি-স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মধুরা ঘোষ বলছিলেন, “মা-বাবারা অনেকেই ইন্টারভিউ-এ ইংরেজি বলা থেকে শুরু করে কী পোশাক পরে যাবেন, কোন প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন, তা নিয়ে অনন্ত জিজ্ঞাসায় ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন।” বেশির ভাগ অভিভাবকেরই পরামর্শ বা গ্রুমিং দরকার হয়। রামধনু-র গ্রুমিং টিচার মালবিকা (রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়)-ও লাল্টু-মিতালিদের ভরসা হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু ছবিতে স্ত্রীর কাছে প্রথম বার এই ‘গ্রুম’ করার কথা শুনে ইংরেজিতে ক’অক্ষর গোমাংস লাল্টু হতভম্ব, “কী বললে, গুম করা হবে?” বাস্তবিক, নামী-দামি স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক অভিভাবকই কার্যত গুম করার মিল পেয়ে থাকেন।

হেদুয়ার বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী এক যুবক যেমন মধ্য কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করাতে গিয়ে ‘ডোনেশন’-এর কথা শুনেছিলেন। একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় অফিসের মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ টাকা দিলে না কী সন্তানের সুযোগ পাওয়া বাঁধা! ওই যুবকের কথায়, “টোপটা গিলব কি গিলব না ভেবেও আমি ভয়ে-ভয়ে পিছিয়ে আসি!” অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সল্টলেকের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পুত্রকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করতে সফল এক তরুণ পিতার উপলব্ধি, “যা বুঝেছি, তিনটি যোগ্যতা অত্যন্ত জরুরি। l মা-বাবার পকেটে রেস্ত l শিক্ষাগত যোগ্যতা l ইংরেজি বলায় সপ্রতিভতা। এর সঙ্গে বাড়িটা স্কুলের কাছে কি না, তা-ও খেয়াল করেন কেউ কেউ।”

প্রশ্ন উঠছে, তথাকথিত ভাল স্কুলে সুযোগটা কি তবে শহরের আলোকপ্রাপ্ত, সম্পন্ন শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

ক্যালকাটা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বাসন্তী বিশ্বাস তা মানতে নারাজ। তাঁর মতে, “সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে মা-বাবার আন্তরিক তাগিদটাই বড়। তাঁদের ইংরেজি বলতে পারা বা টাকার জোর নয়, বাচ্চার জন্য সময় দেওয়ার ইচ্ছেটুকু গুরুত্বপূর্ণ।” একমত হেরিটেজ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সীমা সপ্রু। তিনি বলছেন, “এটা দেখি, বাচ্চারা মা-বাবার কথা শুনছে কি না! স্কুল একা সবটা পারে না। বাচ্চাদের প্রতি মা-বাবার মনোযোগটাও জরুরি।” দরকারে অভিভাবকদের সঙ্গে তাঁদের মাতৃভাষাতেই কথা বলা হয় বলেও জানাচ্ছেন সীমা।

মডার্ন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কাবেরী দত্তর আবার মন্তব্য, “ভারতীয় হয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে আসা মা-বাবাদের ইংরেজি বলতে বাধ্য করাটা বাড়াবাড়ি।” অভিভাবকদের ‘ইন্টারভিউ’-এর অস্তিত্ব নস্যাৎ করে তাঁর দাবি, “ভর্তিটা লটারির মাধ্যমে হয়। অভিভাবকদের স্কুলের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন আছে কি না তা জানতেই আমরা তাঁদের ডেকে কথা বলি।”

তবে লা মার্টিনিয়র ফর বয়েজ স্কুলের সচিব সুপ্রিয় ধরের স্পষ্ট কথা, “বাবা-মায়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ইংরেজি বলতে পারার যোগ্যতাটা ফেলনা বলব না। মা-বাবারা বাড়িতে বাংলা-হিন্দি শুরু করে দিলে তো ইংরেজিটা মার খাবেই!”

এ দেশে শিক্ষা বা চাকরির হাতিয়ার হিসেবে ইংরেজির কথা বাংলা ছবিতে আগেও এসেছে। ’৫০-এর দশকে ছবি বিশ্বাস অভিনীত অগ্রগামী-র ‘হেডমাস্টার’ ছবির কথা মনে করালেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’-য় অপুর কাছে ইংরেজি বই মানে নতুন জানলা। প্রতিদ্বন্দ্বী-তে চাকরির ইন্টারভিউ-এর সময়ে উৎকণ্ঠা, প্রশ্নগুলো কি ইংরেজিতে হবে? সঞ্জয়বাবুর কথায়, “ইংরেজি নির্ভরতার ধাক্কায় স্কুল শিক্ষাটা যে ব্যবসা হয়ে উঠছে বাংলা ছবির এটাও বলার দরকার ছিল!”

রামধনুতে কোনও স্কুলকেই খাটো বা মহান করে দেখানোর চেষ্টা হয়নি বলেই দাবি শিবপ্রসাদ-নন্দিতার। তাঁদের বক্তব্য, “আমরা বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে সাধারণ অভিভাবকদের টেনশনের শরিক হতে চেয়েছি মাত্র।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement