দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকের পরে এক বিকেলে মহাকরণের করিডরে চশমার কাচ মুছতে মুছতে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, “সুন ইউ উইল সি আ নিউ চিফ মিনিস্টার।” একেবারে বসুর নিজস্ব কায়দায় সেটা ছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে তাঁর অবসর এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অভিষেকের ঘোষণা।
এমন কোনও ঘোষণার পথে না গেলেও ভোটে ভরাডুবির পরে এ বার দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বে বদল আনতে চলেছে সিপিএম। বলা যেতে পারে, শেষ পর্যন্ত বিপর্যয়ই পরিবর্তনের গতি বাড়িয়ে দিল!
কেন্দ্র ও রাজ্যের পাশাপাশি বদল আসতে চলেছে বেশ কিছু জেলার নেতৃত্বেও। সিপিএমের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব দলের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনায় পরিবর্তনের একটা রূপরেখা ভেবে ফেলেছেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে তাতে সিলমোহর পড়া বাকি। এর মধ্যে কিছু পরিবর্তন এমনিতেই আসার কথা ছিল। কিন্তু লোকসভা ভোটে বেনজির বিপর্যয়ের পরে সংগঠনে ঝাঁকুনি দিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা করার লক্ষ্যে পরিবর্তনের পরিধি আরও বাড়াতে চাইছে কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং দিল্লির এ কে গোপালন ভবন।
দলের নিচু তলার ক্ষোভ এবং চাপের জেরে জরুরি বৈঠক ডেকে সিপিএম নেতারা অবশ্য পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন না। সাংগঠনিক নিয়ম মেনে, সম্মেলন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই নেতৃত্বে রদবদলের কথা ভাবা হয়েছে। এ কে জি ভবন সূত্রের ইঙ্গিত, চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই পার্টি কংগ্রেস সেরে ফেলা হবে। সে ক্ষেত্রে বিধানসভা ভোটের জন্য আগামী বছরের গোড়া থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে নতুন নেতৃত্বের হাত ধরেই ঘর গোছাতে পারবে সিপিএম। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “সকলকেই মনে রাখতে হবে, পার্টি অফিসে পোস্টার মেরে বা বিক্ষোভ দেখিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে নেতৃত্ব বদলায় না। দলের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনেই যা হওয়ার, হবে।”
সম্পাদক পদে টানা তিন বারের বেশি থাকা যাবে না বলে সিপিএমের গঠনতন্ত্রেই এখন এক ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেই ধারা মেনে সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের এ বার সরে দাঁড়ানোর কথা। বিপর্যয়ের পরে ক্ষোভ সামাল দিতে তড়িঘড়ি ইস্তফা দিয়ে কয়েক মাসের জন্য পরিস্থিতি জটিল করতে চান না তিনি। নিয়মমাফিক পশ্চিমবঙ্গে বিমান বসুর আরও এক দফা রাজ্য সম্পাদক হতে বাধা নেই। কিন্তু এখন তিনি নিজেই আর ওই পদে থাকতে চান না। লোকসভা ভোটের ফল ঘোষণার পরেই তাঁর পদত্যাগের ইচ্ছা কারাটেরা নিরস্ত করেছেন ঠিকই। কিন্তু বিকল্প পথও ভেবে রাখা হচ্ছে। সিপিএম সূত্রের খবর, কারাট এবং বিমানবাবুর জায়গায় তরুণ মুখ দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা কম। দলের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে থেকেই দু’জন আপাতত দায়িত্ব নেবেন। নেতৃত্বের অপেক্ষাকৃত তরুণ অংশকে তৈরি রাখা হবে অদূর ভবিষ্যতের জন্য।
বাম শিবিরের একাংশের প্রস্তাব, সব বাম দলেই এ বার সম্মেলন ডেকে নতুন নেতা নির্বাচন করা হোক একেবারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। সর্ব স্তরে সম্মেলন-কক্ষেই প্রতিনিধিরা বেছে নিন, কে হবেন নেতা। সর্বসম্মত ভাবেও তা হতে পারে, ভোটাভুটিতেও হতে পারে। দলে গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে যখন এত কথা হচ্ছে, এই অবস্থায় আবার নেতৃত্বের তরফেই নামের প্যানেল ঠিক করে দেওয়া উচিত হবে না। গঠনতন্ত্রে ভোটাভুটির সুযোগ থাকলেও সেই পথে সিপিএম নেতৃত্ব হাঁটবেন, তেমন সম্ভাবনা অবশ্য ক্ষীণ।
দিল্লিতে আগামী ৬ জুন পলিটব্যুরো এবং ৭-৮ জুন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই সম্মেলন প্রক্রিয়া এগিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। সিপিএম সূত্রের খবর, সম্মেলন এগিয়ে এনে নেতৃত্বে পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত করার পিছনে ভূমিকা রয়েছে দলের তিন পলিটব্যুরো সদস্যের। তাঁরা তিন জনেই বিপর্যয়ের দায় নিতে চেয়ে দলের গোটা শীর্ষ নেতৃত্বকেই অন্য রকম ভাবতে বাধ্য করেছেন।
পলিটব্যুরোর কাছে যেমন এ রাজ্যে বিশ্রী হারের দায় নিতে চেয়েছিলেন বিমানবাবু, তেমনই কেরলের নেতা এম এ বেবি বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। ভোটের ফলপ্রকাশের পরে প্রথম বৈঠকে পলিটব্যুরোর অন্য দুই সদস্য অবশ্য ফল খারাপ হলেই ইস্তফা দিতে চাওয়ার প্রবণতাকে ‘নাটক’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু তাতে বাদ সাধেন সীতারাম ইয়েচুরি। দলের অন্দরে তাঁর পরিষ্কার যুক্তি, ‘যৌথ দায়িত্ব’ নামক ঢাল ব্যবহার করে নিজেদের আড়াল করার কোনও অর্থই হয় না! মার্ক্স ও লেনিনের কেতাবি নীতি অনুযায়ী, কমিউনিস্ট পার্টি চলে যৌথ কর্মপদ্ধতিতে। কিন্তু ব্যক্তির কিছু দায়িত্ব থাকে। ‘যৌথ দায়িত্ব’ বলে কিছু হয় না! তা হলে তো শুধু রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী রাখলেই চলত, সম্পাদকের আর দরকার হত না! বাংলা থেকে নির্বাচিত সাংসদ ইয়েচুরির বক্তব্য ছিল, এ রাজ্যে দলের বহু বিষয়েই তিনি জড়িত। প্রচারেও অন্যতম ভূমিকা ছিল তাঁর। সে ক্ষেত্রে তিনিও দায় নিয়ে পলিটব্যুরো থেকে সরে দাঁড়াতে তৈরি। বিষয়টি অস্বস্তিকর জায়গায় যাচ্ছে বলে সে যাত্রায় সতীর্থদের নিবৃত্ত করেছিলেন কারাটই। পরে তিনি বিমান-ইয়েচুরিদের সঙ্গে আলাদা করে কথাও বলেছেন। প্রকাশ্যে কারাট অবশ্য এ সব কিছুই অস্বীকার করেছেন। আর ইয়েচুরি এ নিয়ে মন্তব্য করতেই নারাজ।
বাংলা থেকে এখন সিপিএমের চার পলিটব্যুরো সদস্যের মধ্যে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন শারীরিক কারণেই অব্যাহতি নেবেন। আলিমুদ্দিন এবং এ কে জি ভবনের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তাঁর জায়গায় সাংসদ ও সুবক্তা মহম্মদ সেলিমকে পলিটব্যুরোয় জায়গা দেওয়া যায় কি না। দলের একাংশের মত, কলকাতার বাইরে বৈঠকে যাতায়াতে অক্ষম বুদ্ধবাবুকেও এ বার অব্যাহতি দেওয়া হোক। সত্যিই তা হলে বর্ধমানের এক নেতা নাকি কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, এ রাজ্যের এক প্রাক্তন সাংসদপলিটব্যুরোয় কে জায়গা পাবেন, টানাপড়েন হবে তা নিয়ে।