শনিবার কলকাতা বিমানবন্দরে মুকুল রায়। —নিজস্ব চিত্র।
ভিতরে যতই টানাপড়েন, বাইরে ততই কিছু হয়নি বোঝানোর চেষ্টা!
শনিবার দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে রবিবার বনগাঁ দৌড়চ্ছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। উদ্দেশ্য, লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য কর্মিসভা করা। সোমবারই আবার দিল্লি পাড়ি দেবেন তিনি। সেটাও ‘দলের কাজে’!
কিন্তু মুকুল এখনও দলের কতটা ‘কাজে লাগবেন’ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে তৃণমূলের অন্দরেই। সারদা কেলেঙ্কারিতে মুকুলের নাম উঠে আসার পরে ক্রমেই তাঁর ডানা ছাঁটছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তুলে ধরছিলেন ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দলের সাংগঠনিক কাজকর্মের একটা বড় অংশ যে এ বার মুকুলের বদলে তিনি নিজেই দেখবেন, সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। আর শুক্রবার নিজের বাড়িতে দলীয় নেতাদের সভায় তো বলেই দিলেন, একটা মুকুলকে ধরে কিছু করা যাবে না। লক্ষ লক্ষ মুকুল রাস্তায় নামার জন্য তৈরি আছে। দলের একাংশের মতে, মুকুল আর যে দলে অপরিহার্য নন তাই বোঝাতে চেয়েছেন নেত্রী। মুকুল যে দায়িত্ব পালন করেন, তা যে-কাউকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারেন দলনেত্রী।
অথচ, মমতার জনসমর্থনকে ভোটের বাক্সে নিয়ে আসার জন্য যে সাংগঠনিক শক্তি দরকার ছিল, তা তিলে তিলে নিঃশব্দে মুকুলই তৈরি করেছেন বলে মানেন তৃণমূলের একটা বড় অংশ। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও বিরোধী শিবিরে থাবা বসিয়ে একের পর এক পুরসভা-পঞ্চায়েত দখলের কারিগরও তিনি। যা আদতে শাসক দলের আধিপত্যই বিস্তার করেছে। সংগঠনের এ হেন মেরুদণ্ডকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতে ভোটের রাজনীতিতে দল কতটা সাফল্য দেখাতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে তৃণমূলের অন্দরে।
মমতার ঘনিষ্ঠরা অবশ্য মুকুলকে এতটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। দলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, “আরে আসল কথা ক্ষমতা। ক্ষমতা চলে গেলে দক্ষতাও চলে যায়!” তাঁর ব্যাখ্যা, “৩৪ বছর ধরে সিপিএম যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বলা হতো সিপিএমের সাংগঠনিক ক্ষমতা অসাধারণ। কিন্তু ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরে ৩৪ মাসে সেই সংগঠন সাফ!” অর্থাৎ ওই নেতা বোঝাতে চান, মমতার আশীর্বাদ না-থাকলে মুকুলের কোনও গুরুত্বই নেই, তিনি কোনও ফ্যাক্টরও নন।
তা হলে সিবিআইয়ে হাজিরা দেওয়া পিছনোর আর্জিতে আসন্ন উপনির্বাচনকে কারণ হিসেবে কেন দেখিয়েছেন মুকুল? কেনই বা দু’দিনের জন্য কলকাতা ফিরে বনগাঁ যাচ্ছেন কর্মিসভা করতে। তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, এ সবই আসলে ‘কিছুই হয়নি’, এটা দেখানোর কৌশল। সেটা মমতার তরফেও, মুকুলের তরফেও। একদা দলের অঘোষিত দু’নম্বর পুরোপুরি বসে গেলে যে অস্বস্তিকর ছবিটা তৈরি হবে, সেটা এড়াতে চান দু’জনেই।
কিন্তু রেলের সঙ্গে আইআরসিটিসি-র চুক্তির সূত্রে সারদা-কাণ্ডে প্রথম যখন মমতার নাম উঠে আসে, তখনই তাঁর সঙ্গে মুকুলের দূরত্ব তৈরির সূত্রপাত। মুকুল তখন মমতার পাশে না-দাঁড়িয়ে দায় ঝেড়ে ফেলে বলেছিলেন ‘আমি তখন রেলমন্ত্রী ছিলাম না।’ বস্তুত, তার পর থেকেই দলে অ-মুকুলায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় বলে তৃণমূল সূত্রের দাবি। দলের সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব মুকুলের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং ‘যুবরাজ’ অভিষেকের মধ্যে ভাগ করে দেন মমতা।
মুকুল সিবিআইয়ের তলব পাওয়ার পরে মমতার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব আরও স্পষ্ট হয়। রীতিমতো কৌশলে সাংবাদিকদের কাছে উত্তরবঙ্গের ডেলোতে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা স্বীকার করে নেন মুকুল। ওই বৈঠকে খোদ মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন বলে সারদা কাণ্ডের তদন্তকারীদের কাছে আগেই অভিযোগ করেছিলেন তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ, জেলবন্দি কুণাল ঘোষ। মুকুল অবশ্য মমতার নাম করেননি। পরে ডেলোর বৈঠক কবুল করার কথাও অস্বীকার করেছেন।
দলে অ-মুকুলায়ন প্রক্রিয়া যে পুরোদমে চলছে তার আঁচ পড়েছে জেলা স্তরেও। এ দিন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের বর্ধিত সভা ছিল মেদিনীপুরে। দলের একটি সূত্রে খবর, সেখানে জেলা তৃণমূল সভাপতি দীনেন রায় জানান, এ বার দলের কোনও কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়ে প্রচার করতে হলে শুধু দলের নামই বলতে হবে। কোনও নেতার নাম বলা যাবে না। তাঁর মতে, কোনও সভায় মুকুল রায়, কোনও সভায় শুভেন্দু অধিকারী থাকতে পারেন। তবে সভাটিকে মুকুল রায়ের সভা, কিংবা শুভেন্দু অধিকারীর সভা বলে প্রচার করা যাবে না। বলতে হবে তৃণমূলের সভা।
কেন নেতাদের নাম বলা যাবে না? এটা কি রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ? জবাব এড়িয়ে দীনেনবাবু বলেন, “এটা দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সভায় কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কিছু বলব না।”
প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও মুকুল যে আর অপরিহার্য নন, সেই বার্তা দলের সর্বস্তরে চলে গিয়েছে বলেই তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য। যা নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের মন্তব্য, “মুকুলের দিদি তো ঠিকই বলেছেন। এক জন দুর্নীতিগ্রস্ত মুকুল জেলে গেলে দলে আরও লক্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত মুকুল জন্মাবে।” আর নদিয়ার বগুলায় দলের কর্মিসভায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “দিদির বিপদ বাড়ছে, তাই এখন লক্ষ মুকুলের কথা বলছেন।”
সারদার বিপদ থেকে উদ্ধার কী ভাবে পাওয়া যায়, তা নিয়ে অবশ্য তৎপরতা অব্যাহত তৃণমূলে। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক এবং আইনি দুই পথই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এবং সে জন্যই ঘন ঘন দিল্লি যাচ্ছেন মুকুল। রাজ্য সরকার, দল অথবা ব্যক্তিগত ভাবে কোন পথে মামলা করলে ফল মিলতে পারে তা বোঝার জন্য দিল্লিতে নামজাদা আইনজীবীদের সঙ্গে শলাপরামর্শও চলছে বলে খবর। নবান্নের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্ত চেয়ে রাজ্যের তরফে মামলা করার কথা ভাবা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মুকুলের সঙ্গে রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও দিল্লি যাওয়ায় সেই জল্পনা জোরদার হয়। চন্দ্রিমা অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, “মামলার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।” মুকুলও বলেছেন, “আমি কোনও মামলা করছি না।”
যদিও দিল্লির তৃণমূল সূত্র বলছে, সিবিআইয়ের হাতে সম্ভাব্য গ্রেফতারি এড়াতে যে আইনি পথগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তদারকি করতেই সোমবার ফের দিল্লি আসছেন মুকুল। কংগ্রেস নেতা তথা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কপিল সিব্বলের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হতে পারে। যে সম্ভবনাকে কটাক্ষ করে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেন, “তদন্তে হস্তক্ষেপ করে আসলে অভিযুক্তদের বাঁচাতে চাওয়া হচ্ছে। যে গরিব মানুষগুলো প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের কথা এখন ভুলে গিয়েছে তৃণমূল।”
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “রাজ্য সরকার জনগণের ১১ কোটি টাকা খরচ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিল। কিন্তু সিবিআই তদন্ত আটকাতে পারেনি। সরকার যা-ই করুক, ওঁকে (মুকুল) এবং রাজ্যের এক নম্বর ব্যক্তিকে জেলে যেতেই হবে।”