মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর।
নিজের জালে নিজেই বন্দি! বা নিজের চালে নিজেই মাত! ঠিক যে পথে বাম এবং কংগ্রেসকে ধাক্কা দিতে এই সে দিন পর্যন্ত মরিয়া হয়ে ঝাঁপাতেন মুকুল রায়েরা, বৃহস্পতিবার সেই অস্ত্রেই তৃণমূলকে ঘায়েল করল রাহুল সিংহের দল! তৃণমূল নেতৃত্বের পরোয়া না করে মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর যখন সটান বিজেপি দফতরে হাজির হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলোধোনা করলেন, একই সঙ্গে জোড়া জ্বালা টের পেল শাসক দল! একে তো মন্ত্রিসভার বর্তমান কোনও সদস্য এ ভাবে রাতারাতি বিরোধী শিবিরে নাম লেখাচ্ছেন, এমন নজির এ বঙ্গে বিরল। সেই ধাক্কাই দ্বিগুণ হয়ে তৃণমূল শিবিরে লাগছে। কারণ শাসক দলের নেতারা বুঝতে পারছেন সাম্প্রতিক অতীতে এ খেলার সূচনা করেছিলেন তাঁরাই!
বাম জমানায় পরিবর্তনের হাওয়া প্রথম উঠতে শুরু করে ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে। সেই ভোটে বামফ্রন্টের শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি-র তৎকালীন দু’জন সাংসদকে তৃণমূলের টিকিট দিয়েছিলেন মমতা। তাঁরা সে বার জেতেননি। কিন্তু ২০১১-এ বিধানসভা ভোটে জিতে তাঁদের এক জন রাজ্যে মন্ত্রী হন। পরিবর্তনের ইঙ্গিত যখন রাজ্যের রাজনৈতিক হাওয়ায় স্পষ্ট, সেই সময়ে দলত্যাগীদের বরণ করে নেওয়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল তৃণমূলে। কংগ্রেস ছেড়ে সুখেন্দুশেখর রায় এলেন, তো তিনি রাজ্যসভার সাংসদ! সিপিএম থেকে আবু আয়েশ মণ্ডল বিতাড়িত হলেন, তো তিনি উপুর্যপুরি তৃণমূলের প্রার্থী! বিরোধীদের অভিযোগ, তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় বসে যাওয়ার পরে মূলত কংগ্রেস এবং কিছুটা বাম শিবির ভেঙে লোক জোগাড়ের খেলা বজায় ছিল দলের এক শীর্ষ নেতার নেতৃত্বে। সর্বশেষ সংযোজন, কংগ্রেসের পাঁচ বিধায়ক। তাঁরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু এখনও ইস্তফা দেননি!
আর এখানেই মঞ্জুলকে নিয়ে ঢোক গিলতে হচ্ছে তৃণমূলকে। বিরোধীদের একাংশ বলছেন, যে দলত্যাগ-বিরোধী আইন মঞ্জুলের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারতেন তাঁরা, তাতে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসা বিধায়কেরাও বিপাকে পড়বেন!
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাই শুধু বলেছেন, “দল তার গঠনতন্ত্রে নির্দেশিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেবে।” সেই সঙ্গেই তিনি পাল্টা মঞ্জুলবাবুকে দুষেছেন, “এত যখন নৈতিকতা বোধ, তখন বিধানসভার সদস্যপদ ছাড়লেন না কেন?” যা শুনে কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার প্রশ্ন, “নৈতিকতা বোধ থাকলে তো পার্থবাবুরা কংগ্রেস থেকে নেওয়া পাঁচ বিধায়ককে ইস্তফা দিইয়ে নির্বাচনে যেতেন!” আর সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলছেন, “মুকুল রায় তো উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে সকলের হাতে তৃণমূলের পতাকা ধরাতেন! এখন দেখা যাচ্ছে, বিজেপি তাঁদের সঙ্গে সেটাই করছে!”
দলত্যাগ-বিরোধী আইন অনুযায়ী, তৃণমূল স্পিকারের কাছে আবেদন জানালে মঞ্জুলের বিধায়ক-পদ খারিজ হয়ে যাওয়ার সংস্থান আছে। কিন্তু সেই আবেদন করতে গেলে প্রশ্ন উঠবে, তা হলে কংগ্রেস ছেড়ে আসা ইমানি বিশ্বাস, সুশীল রায়, গোলাম রব্বানি, অসিত মাল, উমাপদ বাউড়িদের ক্ষেত্রে পৃথক ফল কেন? তৃণমূল যদি মঞ্জুলকে বহিষ্কৃত বলে ঘোষণা করেন, তা হলে তিনি দলহীন বিধায়ক হিসেবে থেকে যেতে পারবেন!
রাতে মঞ্জুলকৃষ্ণ দাবি করেছেন, মন্ত্রিত্বের সঙ্গে বিধায়ক-পদ থেকেও ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, বিকাল ৫টা পর্যন্ত তিনি দফতরে ছিলেন। তখনও পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি। বিমানবাবুর কথায়, “বিধায়ককে স্পিকারের কাছে সশরীর হাজির হয়ে ইস্তফা দিতে হয়। আমি যত ক্ষণ ছিলাম, উনি আসেননি।”
নানা কারণে জেরবার তৃণমূলে ভাঙনের আশঙ্কা এখন প্রবল। বিজেপি নেতারাও দাবি করে চলেছেন, তৃণমূলের অনেক নেতা-মন্ত্রী-সাংসদই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। রাহুলবাবু এ দিনও একই দাবি করেন। তাতে আরও আতঙ্ক ছড়িয়েছে শাসক দলে! অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেই লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সৌমিত্র খাঁ বা ফ ব-র সুনীল মণ্ডলকে দিব্যি টিকিট দিয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তাঁরা জিতেও এসেছিলেন। তখন তৃণমূল নেতারা ভাবেননি, এত দ্রুত সেই কৌশল ব্যুমেরাং হয়ে আসবে!
মানসবাবু তাই বলেন, “নিজেদের আনা সংস্কৃতিতে নিজেরাই বলি হচ্ছে তৃণমূল!” সেলিমের মন্তব্য, “বিদ্বজ্জন, তারকা থেকে অন্য দলের নেতাদের দলে টানা সবেতেই মমতার পথে বিজেপি। কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো তৃণমূলের বাসা থেকে বিজেপি-র ছানা বেরোচ্ছে!”