বক্তব্য একই। তবে নেত্রীর নির্দেশে অনেকটাই বদলে গিয়েছে ভাষা ও বলার ধরন।
ক’দিন আগেই অরুণ জেটলির বাজেট পেশের সময় তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদরা রীতিমতো তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ শানিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনা ও কালো টাকা উদ্ধারে মোদী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে রীতিমতো মুখর ছিলেন তাঁরা। আজ কিন্তু দেখা গেল লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক নরম সুরে বাম জমানার ঋণের ফাঁস থেকে বাংলাকে মুক্ত করার আবেদন জানালেন সরকারের উদ্দেশে।
নাটকীয় বদলটা যে আজই প্রথম ঘটল তা নয়। গত পরশুই ট্রাই সংক্রান্ত আইন সংশোধনের বিল রাজ্যসভায় উতরে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পাশে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে তৃণমূলকে। যা নিয়ে বামেদের কটাক্ষও হজম করতে হয়েছে তৃণমূলকে।
কেন্দ্রের নতুন সরকারের কাছে রাজ্যের দীর্ঘদিনের দাবিগুলি তুলে ধরার পাশাপাশি সুদীপবাবু আজ পরোক্ষে বাম-কটাক্ষেরও জবাব দেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “সরকার সাধারণ মানুষের কথা ভেবে কোনও সিদ্ধান্ত নিলে অবশ্যই তাকে সমর্থন করবে তৃণমূল। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তাকে প্রতি পদে সমালোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। শুধু সমালোচনা নয়, আমরা ইতিবাচক পরামর্শও দিতে চাই। এর আগেও ইউপিএ সরকারের কাছে বারবার আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিয়েছি, প্রতিবাদ জানিয়েছি। কিন্তু তারা কান দেয়নি। আশা করি নতুন সরকার আমাদের কথা শুনবে।”
রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, এই সুর বদলের পিছনে রয়েছে তৃণমূল নেত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ। মাঝে স্পিকারকে রাজনৈতিক আক্রমণ করে দলকে বেশ খানিকটা বিব্রত করেছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের চাপে তাঁকে ক্ষমাও চাইতে হয় সংসদে দাঁড়িয়ে। আজও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির অভিনয় জীবনের প্রসঙ্গ তুলে বিতর্ক বাধান তৃণমূলের সুলতান আহমেদ। স্মৃতি এর প্রতিবাদ করলে তাঁকে সমর্থন জানান কংগ্রেসের সাংসদ। যদিও মমতার নির্দেশ ছিল, প্রতিবাদ করতে হবে শালীনতার সীমায় থেকে। পালন করতে হবে দায়িত্বশীল বিরোধীর ইতিবাচক ভূমিকা।
সুদীপবাবু আজ নেত্রীর নির্দেশই পালন করেছেন। ‘ইতিবাচক পরামর্শ’ হিসেবে তিনি আজ পশ্চিমবঙ্গের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, “এই আদলেই গোটা দেশে দরিদ্র ছাত্রীদের জন্য একটি প্রকল্প নিক সরকার। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ নিতেও জেটলিকে অনুরোধ করেন সুদীপবাবু। দু’শো কোটি টাকা ব্যয়ে বল্লভভাই পটেলের মূর্তি বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্র। এই প্রসঙ্গ তুলে বিবেকানন্দের মূর্তি বসানোর পরামর্শ দেন সুদীপ।
বিরোধিতার ধরনে এই বদল আনার পিছনে তৃণমূলের রাজনৈতিক কৌশল স্পষ্ট। বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে আসা সরকারকে চাপে ফেলে, সংসদে ডামাডোলের পরিস্থিতি তৈরি করে বাংলার কিছু লাভ হবে না। গাজায় হামলার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের মুখেও কেন্দ্র নিজের অবস্থানে অনড়। ফলে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে, ভারসাম্যের কৌশল নিতে চাইছে তৃণমূল। বাজেটের উপরে ভোটাভুটির সময় তারা বিরুদ্ধেই ভোট দেবে। কিন্তু বাজেটের সমালোচনার সুর থাকবে নরম।
ভবিষ্যতে পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রভাব বাড়ানো বা তাদের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টাও চালাতে চায় মমতার দল। যে কারণে কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বামশাসিত ত্রিপুরা ও নবীন পট্টনায়কের রাজ্য ওড়িশার কথাও উল্লেখ করেন সুদীপবাবু। আর নিজের রাজ্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “৩৪ বছরের কমিউনিস্ট শাসনে দু’লক্ষ কোটি টাকার ঋণের বোঝা চেপেছে পশ্চিমবঙ্গের উপর চেপেছে। আমরা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে গিয়েছি। এই ঋণ থেকে আমাদের মুক্তির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি আমরা।”
কি শরিক হিসেবে, কি বিরোধী হিসেবে, মনমোহন সিংহের সরকারের কাছ থেকে কিছুতেই এই দাবি আদায় করতে পারেনি তৃণমূল। বিরোধিতার ধরন বদলে, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় কি তা আদায় করা সম্ভব হবে? সুদীপবাবুরা মুখে অন্তত ‘আশাবাদী’।