বাইরে থেকে হাবভাব দেখলে মনে হবে, দলটা বুঝি আর ক্ষমতায় নেই!
ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে পড়ন্ত বিকেল। জাঁকিয়ে বসছে ঠান্ডা। আর ততই যেন থমথমে দেখাচ্ছে তপসিয়ার তৃণমূল ভবনটাকে। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের গ্রেফতারির খবর এসে গিয়েছে।
রাজ্যের শাসক দলের সদর দফতরের সামনে রোজকার মতো গাড়ির সারি নেই। অন্য দিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা কর্মী-সমর্থকদের কলরবে মুখর থাকে তৃণমূল ভবন। এ দিন সেই ছবিটাই নেই। নেই জটলা-ভিড়। কিছু চিন্তিত মুখ আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। চাপা গলায় কথাবার্তা। সার বিষয়বস্তু একটাই এর পর কে?
ভবনের একতলায় কিছু কর্মী বড় বড় চোখ করে টিভি দেখতে ব্যস্ত। পাশের ঘরে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র গুটিকয়েক অনুগামী নিয়ে বসে। নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। বাকি সব ঘর, দোতলায় শীর্ষ নেতাদের ঘরে তালা ঝুলছে।
পাঁচটা পেরোল। একটু পরেই এলেন দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। ঠিক পেছন পেছন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। একে একে আসতে লাগলেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সাধারণ সম্পাদক অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিম, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শঙ্কুদেব পণ্ডা। ‘দাদারা’ কিছু বলবেন কি? উপস্থিত হাতেগোনা কর্মী-সমর্থকরা উৎসুক হয়ে উঠলেও নেতারা সকলেই গম্ভীর মুখে দোতলায় উঠে গেলেন। জরুরি বৈঠক বসল রাজ্য সভাপতির ঘরে। কিছুক্ষণ পরে যে বৈঠকে এলেন অধুনা এনআরএস-বিতর্ক খ্যাত বিধায়ক নির্মল মাজি, পুরসভার দুই মেয়র পারিষদ সুশান্ত ঘোষ, দেবব্রত মজুমদার। বৈঠকে ডাক পড়ল অশোক রুদ্রেরও।
পরিবহণমন্ত্রীর গ্রেফতার নিয়ে কিছু বলবেন?
বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে প্রশ্নটা শুনে ফিরহাদ বললেন, “বলার আর কী আছে! বিজেপির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করলে আমাদের জেলে যেতে হবে! আমরা জেলে যেতে প্রস্তুত।” ফাঁকতালে আর এক মন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে গেলেন, শনিবার থেকেই পথে নামবেন তাঁরা। বিজেপিকে বুঝিয়ে দেবেন, তারা ‘আগুন নিয়ে খেলছে’। নেত্রীও কি পথে নামবেন? নেতারা সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে পার্থবাবু নবান্নে বলেছিলেন, মদনের গ্রেফতারির প্রতিবাদে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আজ, শনিবার গোষ্ঠ পালের মূর্তির পাদদেশ থেকে খেলোয়াড়-সহ ময়দানের লোকেরা মিছিল করবেন। তৃণমূল ভবনের বৈঠকের পরে একটি সূত্রে জানা যায়, ওই মিছিলে দলের ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনের নেতা-কর্মীদের যেতে বলা হয়েছে। বিশেষত কলকাতার লাগোয়া জেলাগুলি থেকে লোক নিয়ে যেতে বলা হয়েছে নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের।
এ সবের মধ্যেও একটা হিসেব মিলছিল না। এমন আপৎকালীন বৈঠক, সেখানে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নেই কেন?
তিনি, মুকুল রায় ইদানীং তৃণমূল ভবনে আসেন কম। সারদা কাণ্ডে নাম জড়ানোয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সময়ে তাঁকে দূরে ঠেলেছিলেন। পরে এই তৃণমূল ভবন থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির পিছনের সিটে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল তাঁর। এ দিন কিন্তু অদ্ভুত এক গোপনীয়তা বজায় রাখলেন মুকুল। ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, “আমি বাইরে আছি।” বাইরে কোথায়, মুকুল বলেননি। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী বললেন, “দাদা মিটিংয়ে ব্যস্ত।’’ কোথায়? দিল্লিতে? সহযোগীটির উত্তর, “না, না দিল্লিতে নয়। এখানেই।’’ বলেই তিনি ফোন কেটে দেন। আর এক যুব নেতা বললেন, “মুকুলদা কোথায়, বলা যাবে না। আমাদের বলা বারণ আছে।”
দলীয় সূত্রে অবশ্য জানা গেল, এ দিন দুপুরটা নিজাম প্যালেসেই কাটিয়েছেন মুকুল। তার পরেই কোথায়, কী ভাবে তিনি অন্তর্হিত হয়েছেন, কেউ আর খোলসা করেননি। তবে কিছু কর্মী ফিসফাস করছিলেন, “এ বার কি তা হলে দাদার পালা?” প্রশ্নটা স্বাভাবিক। তাঁদের নেত্রী যে বলেছিলেন, “কুণাল চোর! মদন চোর! টুম্পাই চোর! মুকুল চোর! আমি চোর!” প্রথম তিন জনের ভাগ্য একই খাতে বইতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
সন্ধে সাড়ে ছ’টা। ফিরহাদ তৃণমূল ভবন ছাড়লেও পার্থবাবুরা তখনও দোতলায় রয়েছেন। কিন্তু এ বার শঙ্কুদেব হাতজোড় করে সাংবাদিকদের অনুরোধ করলেন ভবন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। বললেন, “এখানে আজ আর কিছু বলা হবে না। আপনারা দয়া করে আসুন।” রাত আটটা বাজতে না বাজতেই তৃণমূল ভবন ফাঁকা।
রসিকতা করে এক সাংবাদিক বললেন, ‘‘মুকুল-অন্তর্ধানই বা কেন, আর কেনই বা সাংবাদিকদের তড়িঘড়ি সরানো হল সবটাই হাইলি সাসপিশাস! ফেলুদা হয়তো রহস্য ভেদ করতে পারত!”