ঠাকুরবাড়ির বাইরে তৃণমূলের বিক্ষোভ।
তৃণমূলের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর দল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন বৃহস্পতিবার বিকেলে এ খবর পৌঁছতে তেতে উঠল ঠাকুরনগরে মতুয়াদের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ি।
পুলিশের উপস্থিতিতেই ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে ‘মঞ্জুল ঠাকুর মুর্দাবাদ’, ‘সুব্রত ঠাকুর দূর হটো’ স্লোগান দিয়ে দাপাতে দেখা গেল মোটরবাইকে আসা কিছু লোককে, এলাকায় যারা তৃণমূলের সভা-মিছিলে পরিচিত মুখ। মিনিট কুড়ি দাপিয়ে তারা যখন ক্ষান্ত হল, তখন পুলিশকর্মীদের বলতে শোনা গেল, “ভোট না মেটা পর্যন্ত সিআরপি মোতায়েন রাখা উচিত। যে কোনও সময় গণ্ডগোল হতে পারে।”
দাপাদাপি যখন চলছে, মতুয়া সম্প্রদায়ের ‘বড়-মা’ বীণাপাণিদেবী তখন নিজের ঘরে ঘুমন্ত। মঞ্জুল এবং তাঁর বড় ছেলে সুব্রত বাড়িতে ছিলেন না। ছিলেন না মঞ্জুলের বৌদি মমতাবালা ঠাকুর, যাঁকে তৃণমূল বনগাঁ লোকসভায় উপ-নির্বাচনে প্রার্থী করেছে। রাজনীতি যে ঠাকুরবাড়িতে ‘ফাটল’ ধরাবে, সে ইঙ্গিত লোকসভা ভোটের আগে থেকেই পাচ্ছিলেন মতুয়া-ভক্তেরা। তাঁরা জানেন, ওই ভোটে মঞ্জুল চেয়েছিলেন, সুব্রতকে তৃণমূলের প্রার্থী করতে। ছেলে টিকিট না পাওয়ায় দলে নিজের ঘনিষ্ঠ মহলে যাঁর দিকে আঙুল তুলেছিলেন মঞ্জুল, তিনি উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, যিনি দীর্ঘদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির মধ্যে সেতু হয়ে বহু দায়িত্ব সামলেছেন।
বাঁ দিকে, কলকাতা থেকে ঠাকুরনগরে ফিরলেন সুব্রত ঠাকুর।
ডান দিকে, একই সঙ্গে এলেন মঞ্জুলও। মাঝে, ঠাকুরবাড়িতে বিক্ষোভ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের।
তৃণমূল অন্দরের খবর, মমতা যখন মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণকে লোকসভায় প্রার্থী করেন, তখনই ঠাকুরবাড়িতে রাজনৈতিক বিভাজনের বীজ পোঁতা হয়ে যায়। কপিল-মঞ্জুলের পারিবারিক সমস্যা বহুচর্চিত। কপিলের মৃত্যুর পরে দেখা যায়, মমতাবালাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের একটি প্রভাবশালী অংশ। মঞ্জুল-ঘনিষ্ঠদের দাবি, সদ্য প্রাক্তন (এ দিনই বরখাস্ত হয়েছেন) মন্ত্রীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, জ্যোতিপ্রিয়বাবুর অগোচরে এমন ঘটছে না। মঞ্জুলের কথায়, “ঠাকুরবাড়িতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছেন জ্যোতিপ্রিয়। এর শাস্তি ওঁকে পেতেই হবে।”
কলকাতায় এ দিন যখন বনগাঁ উপনির্বাচনের জন্য তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মমতাবালা ঠাকুরের নাম ঘোষণা করছেন উপেন বিশ্বাস, তখন জ্যোতিপ্রিয় সেখান হাজির। মঞ্জুলের অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেছেন, “পাগলের প্রলাপ।” জুড়ে দিচ্ছেন, “কেউ যদি মনে করেন ইছামতীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন, তা হলে কী করতে পারি! উনি আর সুব্রত চলে যাওয়ায় দলে কোনও প্রভাব পড়বে না। ভোটে তো নয়ই।” মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠদের দাবি, মঞ্জুল এবং সুব্রতর সাংগঠনিক শক্তি কেবল গাইঘাটাতেই সীমাবদ্ধ। ওই লোকসভার বাকি ছ’টি বিধানসভার মতুয়া-ভোটের পুরোটাই আসবে তৃণমূলের ঝুলিতে।
জেলা রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশ অবশ্য ভিন্নমত। তাঁদের বক্তব্য, হাওয়া ইদানীং শাসক দলের পক্ষে বইছে না। সারদা-কাণ্ড, খাগড়াগড় বিস্ফোরণে জামাত-যোগে নাম জড়ানোয় তৃণমূল এখন কোণঠাসা। বনগাঁ লাগোয়া বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে বিধানসভা উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। নিয়মিত এলাকায় সভা-সমিতি, মিছিল করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে গেরুয়া শিবির।
তা ছাড়া, ও পার বাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় বিজেপির সাম্প্রতিক ভূমিকাও সদর্থক ঠেকেছে মতুয়াদের একটা অংশের কাছে। মতুয়া এবং হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়ার দাবিতে সম্প্রতি অনশন করেন সুব্রত। সেখানে কোনও তৃণমূল নেতাকে দেখা না গেলেও বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা ঘুরে গিয়েছেন। তাঁদের হস্তক্ষেপেই অনশন তোলেন সুব্রত। এ দিন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ জানান, বনগাঁ লোকসভা এবং কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার জন্য পাঁচটি করে নাম কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে পাঠানো হয়েছে। তাঁরাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। বিজেপি সূত্রের খবর, বনগাঁর জন্য সুব্রত-মঞ্জুলের নাম তো আছেই। আরও আছেন কেডি বিশ্বাস, প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ সুচারু হালদারের ছেলে সুস্মিত এবং প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক বীথিকা মণ্ডল। তবে পাল্লা ভারী ঠাকুরবাড়ির দিকেই।
বিজেপি সুব্রতকে প্রার্থী করলে মতুয়া-ভোট ভাগ হবে না? মমতাবালার জবাব, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে মনে রাখায়, কৃতজ্ঞ। ভক্তদের সঙ্গে কথা বলি। তার পরে এ প্রসঙ্গে কিছু বলতে পারব।”
ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।