আমরির আগুন, ভাঙড়ের হানাহানি থেকে শুরু করে হালের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ বা সারদা কেলেঙ্কারি। এসএসকেএমের নাম জড়াচ্ছে সর্বত্র। উঠছে প্রশ্নও, যার কোনও সদুত্তর মিলছে না।
সাড়া জাগানো হরেক ঘটনায় অভিযুক্ত বিভিন্ন ‘নামজাদা’ বিচারাধীন বন্দির কার্যত ঘরবাড়ি হয়ে উঠছে এসএসকেএম। কেউ সামান্য অসুস্থ বোধ করলেই জেল হাসপাতালের বদলে সটান পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই সুপার স্পেশ্যালিটি সরকারি হাসপাতালটিতে, যেখানে এমনিতেই শয্যা বাড়ন্ত। এর উপরে ‘হাই প্রোফাইল’ বন্দিদের আগমনের দরুণ সেখানে সাধারণ রোগীদের প্রাপ্য পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালেরই অন্দরে। পাশাপাশি সংশয় জাগছে, জেলের হাসপাতালগুলোকে কেন সুচিকিৎসার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হবে না?
সরকারি ভাবে স্পষ্ট উত্তর কেউ দিতে পারেননি। এসএসকেএমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এক বছরে সেখানকার কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে ১২০৫ জন রোগীকে শয্যা-না থাকার কারণে অন্যত্র রেফার করা হয়েছে। মেডিসিন ফিরিয়েছে ১৪০০ রোগীকে। রিউম্যাটোলজি’র কেবিন পাননি ৩৭৮ জন। স্নায়ুরোগের চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ হয়নি ২৯৮৮ জনের। এরই ভিত্তিতে স্বাস্থ্যভবনের একাংশের দাবি, ১৫-২০ জন বিচারাধীন বন্দির জন্য বহু সাধারণ রোগীর শয্যা না-পাওয়ার যুক্তি খাটে না। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে রোগী প্রত্যাখানের পিছনে হাসপাতালের ‘ব্যর্থতা’র দিকেই আঙুল তুলেছে স্বাস্থ্য-কর্তাদের এই মহল।
সত্যিই কি তা-ই? কয়েক জন ‘ভিআইপি’ বন্দির এসএসকেএম-বাসের দিনগুলোয় চোখ রাখলে অন্য রকম মনে হতেই পারে। প্রথমেই ধরা যাক পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের কথা। সারদা-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়ার আগে-পরে এসএসকেএমে ভর্তি থাকাকালীন তাঁর সেবা-শুশ্রূষায় যে রকম ঢালাও আয়োজন ছিল, বহু চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীর চোখে তা রীতিমতো বিসদৃশ ঠেকেছে, বিশেষত সাধারণ রোগীদের অবস্থার প্রেক্ষাপটে। এমনকী, স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীরা যে যন্ত্রের অভাবে চিকিৎসা না-পেয়ে ফিরে গিয়েছেন, মদনবাবুর জন্য তা রাতারাতি ভাড়া করা হয়। সারদা-কাণ্ডে ধৃত তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষও বন্দিদশায় এসএসকেএমে ক’দিন কাটিয়েছেন। বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে শয্যা দখল করে ছিলেন তিনি। বর্তমানে কার্ডিওলজি-র এসি কেবিনে আছেন সৃঞ্জয় বসু সারদা কাণ্ডে ধৃত তৃণমূল সাংসদ।
উদাহরণ আরও মজুত। যেমন খাগড়াগড়ের মূল অভিযুক্ত হাকিম শেখের পায়ে গুরুতর ক্ষত ছিল। প্লাস্টিক সার্জারির দরকার পড়ে। সেই বিভাগে কেবিন না-থাকায় প্রথমে তাঁকে রাখা হয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)-এ, যেখানে বেড না-পেয়ে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। দিন কয়েক বাদে নিরাপত্তাজনিত কারণে হাকিমকে রিউম্যাটোলজি-র কেবিনে সরানো হয়। সেখানেও শয্যার তুঙ্গ চাহিদা। অথচ হাকিমের সুরক্ষার খাতিরে আশপাশের দু’-তিনটে কেবিনেও রোগী ভর্তিতে রাশ টানা হয়েছিল। এসএসকেএমের এক কর্তার কথায়, “প্রতি দিন শয়ে শয়ে মুমূর্ষু মানুষ ফেরত যাচ্ছেন। কারণ, আমরা বেড দিতে পারছি না। তা হলে ওঁদের জন্য বেডের ব্যবস্থা হচ্ছে কী ভাবে? নিজেদের কাছেই নিজেরা অপরাধী হয়ে যাচ্ছি।”
বিচারাধীন বন্দিদের এসএসকেএমের শয্যায় দীর্ঘ দিন দৃষ্টিকটু দখলদারির ট্র্যাডিশন অবশ্য নতুন নয়। আমরি-কাণ্ডে ধৃত রাধেশ্যাম অগ্রবাল লম্বা সময় ওখানকার কার্ডিওলজি-র কেবিনের অতিথি ছিলেন। তিনি কতটা অসুস্থ, তা নিয়ে বিতর্ক তখন কম হয়নি। একই ভাবে ভাঙড়ের প্রাক্তন তৃণমূল নেতা দোর্দণ্ডপ্রতাপ আরাবুল ইসলাম ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)-এর বেডে শুয়ে দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে আইপডে গান শুনে কাটিয়ে গিয়েছেন। কোনও কিছু না-পসন্দ হলে ডাক্তারদের ধমক দিতেও কসুর করেননি। তাঁরও অসুখের হদিস মেলেনি। বছর পাঁচেক আগে উডবার্নের কেবিনে ভর্তি এক বিচারাধীন বন্দির জন্য তো বাইরের নামী রেস্তোরাঁ থেকে নিয়মিত খাবার আসত! যখন-তখন তাঁর চেনা-পরিচিতেরা ঢুকে পড়ত, কারও কিছু বলার সাধ্য ছিল না। উনি কেবিনে টিভি বসানোর আব্দারও ধরেছিলেন। আব্দার না-মেটায় হাসপাতাল-কর্তাদের বিলক্ষণ বকা-ঝকাও করেছিলেন।
এমন লোকজনকে কীসের ভিত্তিতে এসএসকেএমে পাঠানো হয়? কোর্টের নির্দেশে?
হাসপাতালের কর্তারা জানিয়েছেন, বহু ক্ষেত্রে আদালতের তরফে তেমন নির্দেশ থাকে না। হামেশা জেল হাসপাতাল থেকেই সরাসরি রেফার করে দেওয়া হয়। এবং রেফার করার পিছনে অধিকাংশ সময়ে ‘রাজনৈতিক চাপ’ কাজ করে বলে অভিযোগ। মেডিক্যাল বোর্ড তৈরির চাপও থাকে। “রোজ হাসপাতালে ঢোকার সময় মনে হয়, আজও বোধহয় তিন-চারটে মেডিক্যাল বোর্ড বানাতে হবে। ব্যাপারটা এখন জলভাত হয়ে গিয়ে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।” সহাস্যে বলছেন এসএসকেএমের এক কর্তা। আক্ষেপ করছেন, “সব জেনে-বুঝেও আমরা নিরুপায়। মেডিক্যাল বোর্ড ছাড়া নাকি প্রমাণ হবে না যে, আমরা ঠিকঠাক গুরুত্ব দিচ্ছি!”
বীতশ্রদ্ধ ডাক্তারেরাও। ঘন ঘন মেডিকাল বোর্ডে ডাক পড়ে, এমন এক শিক্ষক-চিকিৎসক জানাচ্ছেন, “কী যে নাজেহাল দশা! ক্লাস নেওয়ার সময়েও বোর্ডের ডাক পড়ছে। এক বার এক জনকে লুকিয়ে-চুরিয়ে ছুটি দেওয়ার জন্য আমাদের তড়িঘড়ি তলব করা হল। অথচ তিন দিন আগে থেকে আমরা বলে যাচ্ছিলাম, ওকে ছেড়ে দেওয়া হোক।” এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের উদ্বিগ্ন পর্যবেক্ষণ, “বিচারাধীন বন্দিদের সকলেরই দেখছি প্রথম ও একমাত্র পছন্দ এসএসকেএম! এ দিকে জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে সাধারণ মানুষ এসএসকেএমের উপরে বেশি ভরসা করেন। ওঁরাই জায়গা পাচ্ছেন না!”
এমতাবস্থায় জেল হাসপাতালের পরিকাঠামো কেন উন্নত করা হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “মান্ধাতার আমল থেকে জেলের হাসপাতালগুলোয় এক অবস্থা! কোনও পরিবর্তন নেই। সেখানে পরিকাঠামো নেই বলেই তো রোগীদের অন্য জায়গায় পাঠাতে হচ্ছে!” সমস্যা সুরাহার আশা কতটা?
তাড়াতাড়ি কিছু হওয়ার আশা যে নেই, রাজ্যের এডিজি (কারা) অধীর শর্মার কথায় তা পরিষ্কার। “জেল হাসপাতালের মানোন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনও তৈরি হয়নি। তবে ভাবনা-চিন্তা চলছে। স্বাস্থ্য-কর্তাদের নিয়ে যৌথ বৈঠক হয়েছে।” বলেছেন তিনি। একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “শুধু জেল হাসপাতালে নয়, রেফারের প্রবণতা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সর্বত্র। পরিকাঠামো বাড়িয়ে কতটা সুরাহা হবে, নিশ্চিত বলা যায় না।”