খাগড়াগড়ে তখন সবেমাত্র বিস্ফোরণ হয়েছে। মেঝেতে পড়ে রক্তাক্ত দু’টি দেহ। স্প্লিন্টারের টুকরো পায়ে ঢুকে ছটফট করছে জখম আর এক জন। তার হাতে লেখা একটি মোবাইল নম্বর। জখম অবস্থাতেই ওই বিস্ফোরণের একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল হাকিম নিজের মোবাইল থেকে ফোন করে ওই নম্বরে। জানায়, বোমা বানানোর সময়ে ফেটে গিয়ে দু’জন মারা গিয়েছে। পরামর্শ চায় হাকিম এখন কী করা উচিত?
ফোনের উল্টো দিকে যে ছিল, তার নাম রেজাউল করিম। বিস্ফোরণের দু’সপ্তাহ পর বর্ধমানের বাদশাহি রোডে যার বাড়িতেই তল্লাশি চালিয়ে মেলে ৩৫টি দেশি গ্রেনেড ও চারটি সকেট বোমা। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ইস্তক তিন মাসেরও বেশি পালিয়ে বেড়ানো সেই রেজাউলকে শনিবার সকালে পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে গ্রেফতার করেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।
গত ৩১ অক্টোবর খাগড়াগড় বিস্ফোরণে ফেরার অভিযুক্তদের তালিকা প্রকাশ করেছিল এনআইএ। সেই সময়ে রেজাউলের হদিস পেতে ইনাম ঘোষণা করা হয় তিন লক্ষ টাকা। পরে তা বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ করা হয়।
এনআইএ-র দাবি, জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর সক্রিয় সদস্য রেজাউল যেমন বোমা বানাতে সিদ্ধহস্ত, তেমনই বোমা তৈরি হওয়ার পর সেগুলি বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শনিবার রেজাউলকে সাহেবগঞ্জ আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তিন দিনের ট্রানজিট রিমান্ড দেন। কাল, সোমবার রেজাউলকে কলকাতায় এনে নগর দায়রা আদালতে হাজির করানোর কথা এনআইএ-র। এই নিয়ে খাগড়াগড়-কাণ্ডে দুই মহিলা-সহ ১২ জন গ্রেফতার হল। খাগড়াগড়-কাণ্ডে এনআইএ এর আগে শেষ গত নভেম্বরে হায়দরাবাদ থেকে গ্রেফতার করেছিল মায়ানমারের নাগরিক মহম্মদ খালিদকে।
গোয়েন্দারা জানান, ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার করনপুরায় তিনপাহাড় থেকে রাজমহল পর্যন্ত রেলপথে ডবল লাইন পাতার কাজ চলছিল। দিন কুড়ি আগে আনোয়ার নাম নিয়ে ওই জায়গায় ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজে ঢোকে রেজাউল। গোয়েন্দারা অবশ্য জানতে পারেন, এক বহিরাগত ওখানে কাজ করছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় কেউই তাকে চেনে না। খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্তকারীরাও বিভিন্ন সূত্রে খবর পাচ্ছিলেন, রেজাউল মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার লাগোয়া পড়শি কোনও রাজ্যে ঘাপটি মেরে রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এর মধ্যে গত ১৭ নভেম্বর রাতে রেজাউল রঘুনাথগঞ্জের পিয়ারাপুর গ্রামের বাসিন্দা, তার এক পুরনো সহপাঠীকে মোবাইল থেকে ফোন করে বাড়ির খবরাখবর জানতে চায়। পর দিনও বার কয়েক তাকে ফোন করে রেজাউল। কিন্তু বিষয়টি ওই ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়ে দেন। তার পর নম্বর ও টাওয়ার লোকেশন ধরে রেজাউলকে অনুসরণ করেন গোয়েন্দারা। এ দিন ভোরে স্থানীয় তালঝাড়ি থানার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এনআইএ-র একটি দল করনপুরায় হানা দিয়ে গ্রেফতার করে রেজাউল ওরফে আনোয়ারকে।
প্রসঙ্গত, তদন্তকারীরা আগেই জানিয়েছিলেন, খাগড়াগড়ে তৈরি হওয়া আইইডি ও গ্রেনেডের একাংশ ঝাড়খণ্ডের পাকুড়, রাজমহলের মতো জায়গা হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। জেএমবি-র সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এই সন্দেহে পাকুড় থেকে দু’জনকে গ্রেফতারও করেন গোয়েন্দারা। সেই সাঁওতাল পরগনাতেই খাগড়াগড় কাণ্ডের অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত রেজাউল কার সূত্রে, কী ভাবে ঠিকা শ্রমিকের কাজ পেল, গোয়েন্দারা সেটা খতিয়ে দেখছেন।
আবার রেজাউলের আদি বাড়ি যেখানে, সেই মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থেকে ঝাড়খণ্ডের করনপুরা একশো কিলোমিটারের মধ্যে। ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ থেকে সড়ক পথে বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদে যোগাযোগ করাও সহজ।
রঘুনাথগঞ্জের খোদারামপুরের ভূতবাগানপল্লির সেই বাড়িতে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর হানাও দিয়েছিল সিআইডি-র দল। খালি হাতে ফিরতে হয় গোয়েন্দাদের। রেজাউলের ছোট ভাই রঘুনাথগঞ্জ থানায় সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে কর্মরত। রেজাউলের বাবা বর্ধমানে রাজমিস্ত্রির কাজ করার সূত্রে গিয়েছিলেন। নবম শ্রেণির পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া রেজাউল বাবার সঙ্গে কাজ শিখতে বর্ধমানে যায়। পরে রেজাউল বর্ধমানেই পাকাপাকি বাসা বাঁধে। খাগড়াগড়-কাণ্ডের মাস তিনেক আগে বর্ধমানের আলমপুরের এক তরুণীকে বিয়ে করে রেজাউল। স্ত্রীকে নিয়ে সে বাদশাহি রোডের বাড়িতেই থাকত। বিস্ফোরণের পর রেজাউলের স্ত্রী-ও বেপাত্তা। ওই তরুণী এখন কোথায়, সে ব্যাপারে গোয়েন্দারা কিছু বলতে পারেননি।
এনআইএ জানিয়েছে, জেএমবি-র চাঁই কওসর ওরফে বোমারু মিজানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এই রেজাউল। খাগড়াগড়ের গবেষণাগারে গ্রেনেড, আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) সকেট বোমা তৈরি হওয়ার পর সেখান থেকে সেগুলি নিয়ে অন্যত্র পৌঁছে দিত মূলত কওসর-ই। বিস্ফোরণ যে দিন হয়, সে দিন বিকেল থেকে তার পর দিন সকালের মধ্যে পর পর শাকিল আহমেদ, আব্দুল করিম, আব্দুল হাকিমদের ওই ডেরা ছেড়ে যার যার বাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ার কথা ছিল।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বীরভূমের মহম্মদ বাজারের দেউচা গ্রামের বাসিন্দা হাকিমকে জেএমবি চাঁই কওসর বলেছিল, কবে আবার বর্ধমানে আসতে হবে, রেজাউলই সেটা বলে দেবে। এনআইএ-র বক্তব্য, রেজাউল খাগড়াগড়-কাণ্ডে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হাকিমকে জেরা করেই প্রথম জানা গিয়েছিল। তদন্তকারীদের বক্তব্য, হাকিমের সঙ্গে ফোনে কথোপকথনের সময়ে কওসর তাকে রেজাউলের মোবাইল নম্বর দেয়। হাকিম হাতের কাছে কাগজ খুঁজে না পেয়ে নিজের হাতেই ওই নম্বর লিখে রাখে। যা পরে তদন্তে এগোতে সাহায্য করে গোয়েন্দাদের।
এক তদন্তকারী অফিসারের বক্তব্য বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরেই খাগড়াগড়ের জঙ্গি ডেরায় ৫৫টি দেশি গ্রেনেড পাওয়া গিয়েছিল। তবে সেটি ছিল বিস্ফোরক ও আইইডি তৈরির গবেষণাগার তথা কারখানা। সেখানে প্রচুর আইইডি মিলবে, তার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু ওই জায়গা থেকে আধ কিলোমিটার দূরে বাদশাহি রোডে নিজের বাড়ির শৌচাগারের মধ্যে চাটাই দিয়ে ফল্স সিলিং তৈরি করে ৩৫টি দেশি গ্রেনেড ও চারটি সকেট বোমা মজুত করে রেখেছিল রেজাউল। এনএসজি (ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড) কমান্ডোদের সহায়তায় সেগুলি উদ্ধার করে এনআইএ। বিস্ফোরণ-কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থল ও বাদশাহি রোডে রেজাউল করিমের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও কিন্তু আইইডি পাওয়া যায়নি।
এনআইএ-র এক কর্তার কথায়, “অতগুলো গ্রেনেড রেজাউল নিজের বাড়িতে মজুত করে রেখেছিল কেন, সেগুলো কোথায় পাঠানোর কথা ছিল, আগে সে কত বার কত বোমা মজুত করেছিল, এ সব জানাটা জরুরি।”
রঘুনাথগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে বসে রেজাউলের বাবা আব্দুল লতিফ ওরফে মণ্টু শেখ টিভি-র খবরে বড় ছেলের গ্রেফতার হওয়ার খবর জানতে পারেন। রেজাউলের বাবা বলেন, “ছেলে অন্যায় করলে শাস্তি পাবে। ওর সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই। ওর জন্য বার বার আমাদের পুলিশের হাতে হয়রান হতে হয়েছে।”
আর বাদশাহি রোডে রেজাউলের বাড়ি তালাবন্ধ হয়েই পড়ে আছে। রেজাউলের পড়শি ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় আলেয়া বিবি বলেন, “আমরা টিভি-তে রেজাউলের গ্রেফতার হওয়ার খবর দেখলাম। ও যে ভাবে ঘরে বোমা রেখেছিল, তা কোনও ভাবে ফেটে গেলে কী হতো, সেটা ভেবেই ভয় করছে।” আর এক প্রতিবেশী সুলতান কাজীর কথায়, “খাগড়াগড়-কাণ্ডের পর থেকে আমাদের এলাকা কুখ্যাত হয়ে গিয়েছে। ওই লোকগুলোর জন্য বাইরে গেলেও আমাদের অস্বস্তিতে পড়তে হয়।”