আদি গোদরেজ
শিল্পপতিদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যখন সুন্দরবন ভ্রমণে, তখনই কলকাতায় এসে রাজ্য সরকারের শিল্পনীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে গেলেন শিল্পপতি আদি গোদরেজ। স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের মতো বস্তাপচা আইন চালু থাকলে শিল্পক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতিই হবে না।
রাজ্যের জমিনীতি নিয়ে গোদরেজের উষ্মা এই প্রথম নয়। এর আগে মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনেই এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “আপনাদের জমিনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পমহল কী ভাবে তাড়াতাড়ি প্রকল্প চালু করতে পারে সেটা বোধহয় দেখা দরকার।” কিন্তু ২০১৩-র সেই বৈঠকের পরেও জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন তুলে দেওয়ার পথে হাঁটেনি মমতার সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের নগরায়ণ নীতি উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে বলবৎ রয়েছে এই আইন। যার জেরে কলকাতার মতো মেট্রো শহরে ৫০০ বর্গমিটার এবং দুর্গাপুর, আসানসোলের মতো শহরে ২০০০ বর্গমিটারের বেশি জমি হাতে রাখতে পারেন না কেউ। ফলে মার খায় বড় মাপের আবাসন প্রকল্প।
ঘরোয়া মহলে শিল্পপতিরা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও প্রকাশ্যে তেমন ভাবে কিছু বলতে চান না। সম্ভবত সরকারের সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর উদ্দেশেই। গোদরেজ প্রপার্টিজ-এর কর্ণধার কিন্তু কোনও রকম রাখঢাক না-করে মনের কথাটা বলে দিয়েছেন। দেশের প্রায় কোনও রাজ্যেই যে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নেই, সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা একটা আদিম আইন। কারও কোনও কাজে আসে না। শুধু নির্মাণ শিল্প নয়, রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেই এই আইন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের উচিত এই আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া।”
জমি নিয়ে শিল্প মহলের এই মনোভাবের কথা জেনে শহর এবং গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা আইনে ছাড় দিয়েছে রাজ্য (গ্রামে ২৪ একরের বেশি জমি রাখতে গেলে ১৯৫৫ সালের ভূমি সংস্কার আইনের ১৪ ওয়াই ধারা অনুসারে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়)। কিন্তু শিল্পমহলের প্রশ্ন, সরকারের পছন্দ-অপছন্দের উপরে কেন নির্ভর করে থাকতে হবে তাদের। সে ক্ষেত্রে তো পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা। তাই তারা এমন আইন সমূল বিনাশেরই পক্ষপাতী।
বাম আমলে ২০০৬-’০৭ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক বার জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শরিকদের আপত্তিতে পিছিয়ে আসতে হয় তাঁকে। ২০১১-য় ক্ষমতায় এসে মমতা স্পষ্টই জানিয়ে দেন সব জমি বৃহৎ শিল্পপতিদের হাতে চলে যাবে, এই আশঙ্কাতেই তিনি ঊর্ধ্বসীমা আইন তুলে দিতে রাজি নন। আবার সেই কারণে শিল্পপতিরাও যে এ রাজ্যে লগ্নি করার কথা বিশেষ ভাবছেন না, সেটা এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন গোদরেজ। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতার বাজারে সব রাজ্যই লগ্নি টানতে চাইছে। সেখানে শিল্প-বিরোধী জমি নীতি নিয়ে মোটেই এগোনো সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণের সমস্যার কথাও ওঠে। এ রাজ্যে জমি ছোট ছোট জোতে বিভক্ত। একলপ্তে জমি পাওয়া কঠিন। অথচ বেসরকারি শিল্পের জন্য এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ করা হবে না বলে জেদ ধরে রয়েছেন মমতা। শিল্পপতিরা তো বটেই এমনকী বিরোধী রাজনৈতিক দল সিপিএম-ও বারবার বলেছে, এ রাজ্যে সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া অজস্র জমি মালিকের সঙ্গে সমঝোতা করে জমি কেনা শিল্পপতিদের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্প্রতি সে কথা কবুল করেছেন মমতা নিজেও। কিন্তু তাই বলে সরকারি হস্তক্ষেপ না-করার নীতি থেকে সরে আসেননি তিনি। শিল্পপতিদের পরামর্শ দিয়েছেন ল্যান্ডব্যাঙ্ক থেকে জমি নেওয়ার। কিন্তু সেখানেও যেমন বড় শিল্পের জন্য একলপ্তে জমি নেই, তেমনই জমি নেই শিল্পপতিদের পছন্দসই এলাকায় যেখানে পরিকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত।
গোদরেজের কথায়, “বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। সামনেই একটি শিল্প সম্মেলন হবে এখানে (জানুয়ারিতে বিশ্ব বাংলা শিল্প সম্মেলন)। সেখানে শিল্পমহল তাদের বক্তব্য জানাবে। সেই বক্তব্যের প্রতি সরকারকে নজর দিতে হবে। এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপও করতে হবে।”
তবে এ দিন কৃষি বিপণন আইনের পরিবর্তনকে স্বাগত জানান গোদরেজ। তিনি বলেন, “বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করব। এ রাজ্যে আমাদের কৃষিপণ্যের ব্যবসা রয়েছে। লগ্নির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।”