কুয়াশায় আটক জাহাজে ‘হোলনাইট’ জলসা

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ন’টা। সুন্দরবনের সপ্তমুখী নদীর রাক্ষসখালি পয়েন্টে ‘এমভি পরমহংস’-এর ক্যাপ্টেনের কেবিন থেকে শোনা গেল, “চিফ অফিসার, গেট দ্য অ্যাঙ্কর স্টেশন রেডি।” ঘন কুয়াশার চাদরে কেবিনের বাইরে তখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দৌড়লেন চিফ অফিসার। খানিক বাদে উত্তর, “স্যার, লেটিং ইট গো।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩১
Share:

ঘরে ফেরা। মিলেনিয়াম পার্কের জেটিতে মুখ্যমন্ত্রী।—নিজস্ব চিত্র।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ন’টা।

Advertisement

সুন্দরবনের সপ্তমুখী নদীর রাক্ষসখালি পয়েন্টে ‘এমভি পরমহংস’-এর ক্যাপ্টেনের কেবিন থেকে শোনা গেল, “চিফ অফিসার, গেট দ্য অ্যাঙ্কর স্টেশন রেডি।”

ঘন কুয়াশার চাদরে কেবিনের বাইরে তখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

Advertisement

দৌড়লেন চিফ অফিসার। খানিক বাদে উত্তর, “স্যার, লেটিং ইট গো।”

ক্যাপ্টেন জানালেন, “লেট ইট (নোঙর) গো ‘ওয়ান শ্যাকল’ (৯০ মিটার)।”

নোঙর বাঁধা ৯০ মিটারের শিকল তরতরিয়ে নামল সপ্তমুখীর গভীরে।

বিলাসবহুল পরমহংসে হালকা টান পড়ল। আর এগোবে না সে। টনক নড়ল যাত্রীদের। ক্যাপ্টেন জানিয়ে দিলেন, কুয়াশার যা অবস্থা তাতে সারা রাত এখানেই থাকতে হবে।

‘হোক কলরব’ আওয়াজ উঠল জাহাজে। খুশি তিনিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সফরসঙ্গী হয়েই তো জনা ৩৫ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পপতি, সাংবাদিক বেরিয়ে পড়েছিলেন সুন্দরবনের পথে। উদ্দেশ্য ছিল পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ টানতে সরেজমিনে সুন্দরবন দেখা। তার মধ্যেই কুয়াশা-বিপত্তির কারণে মাঝদরিয়ায় এমন রাত্রিবাসের সুযোগ এসে যাওয়ায় কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন, “এ বার হোলনাইট শিল্প-টিল্প, গানবাজনা হবে।”

হলও তাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমল মুখ্যমন্ত্রীর জন্য ভাড়া নেওয়া ছোটখাটো জাহাজটার ডেকে। আর সেই পর্ব যখন সাঙ্গ হল, তখন চাঁদও প্রায় ডুবু ডুবু। মাঝের সময়টায় চলল একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক, পুলিশকর্তার গজল থেকে শীল মহাশয়ের স্বরচিত কবিতা। শুনে আহা আহা করলেন উপস্থিত সকলে। দু-এক জন অবশ্য ঠান্ডা লাগা, গলা ধরা, পেটের অসুখের দোহাই দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন কেবিনের আরামে। কিন্তু বাকিদের অধিকাংশই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে স্থায়ী আসন সংরক্ষণের তাগিদে তাঁর নজরবন্দি হয়েই থেকেছেন শেষ পর্যন্ত। এক সফরসঙ্গী জানালেন, যতই মাঝ নদীতে জাহাজ আটকে যাক, সওয়ারি যেখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সেখানে চিন্তা কী! পরমহংস তো পরিবৃত হয়ে রয়েছে আট-দশটি কোস্টাল পুলিশের লঞ্চে।

সেই লঞ্চগুলি থেকেই সারা রাত টানটান হয়ে থাকা নিরাপত্তা কর্মীরা দেখেছেন, জাহাজের ডেকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছেন তাঁদের ‘সাহেব’। পুলিশ সুপারের পার্টনার জেলাশাসক শান্তনু বসু। মুখ্যমন্ত্রীর র্যাকেট সঙ্গী কখনও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, কখনও এক সাংবাদিক। সুন্দরবনের চক্করে মুখ্যমন্ত্রীর বৈকালিক হাঁটাটা হয়নি। সেই অভাব পুষিয়ে দেয় ব্যাডমিন্টন। সারাদিনের ঝক্কি থাকলেও ‘ম্যাডাম’-এর সঙ্গে র্যাকেট ধরতে নাকি মঙ্গলবারের রাতে লাইনও লেগেছে সপ্তমুখীর বুকে।

কম যাননি গায়ক তথা লোকসভা ভোটে বহরমপুরে পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেন। নিশিরাতে ডেক-জলসার আসরে গান গেয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী যা শুনতে চেয়েছেন, তা-ই শুনিয়েছেন। ডাক পড়েছে উপকূল পুলিশের ডিজি রাজ কানোজিয়ার। দু’টো গজল তিনিও গেয়ে তারিফ কুড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁর সতীর্থদের কেউ কেউ মুখ টিপে বলেন, “পরবর্তী ডিজি-র লড়াইয়ে ঢুকে পড়লেন মনে হচ্ছে।” হালে তৃণমূলের তরীতে আসা অরিন্দম শীল রবীন্দ্র-নজরুলে যাননি। স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন মুখ্যমন্ত্রীর সামনে। আর এক কবি সুবোধ সরকার ‘পারফর্ম’ করতে পারেননি। তিনি গলার ব্যথায় কাতর। তবে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া ওষুধ টপাটপ গিলে যতক্ষণ পেরেছেন, সঙ্গ দিয়েছেন। শিল্পপতি উত্‌সব পারেখ হিন্দি কোরাসে চুটিয়ে গেয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী খুশি। তা শুনে ওই শিল্পপতি আরও খুশি।

পরমহংসের ডেকে কিঞ্চিত্‌ লোকসংস্কৃতিরও আয়োজন করেছিল জেলা প্রশাসন। স্পিডবোটে তুলে আনা হয়েছিল বনবিবি পালাকারদের। ৪৫ মিনিটের পালা শিল্পপতিদের সঙ্গে নিয়ে উপভোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুরস্কার দিয়েছেন। পালাকারদের কন্যাশ্রী, যুবশ্রী-র প্রচারের কাজে লাগিয়ে তাঁদের জন্য কিছু আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করতে জেলাশাসককে নির্দেশও দেন তিনি।

রাত ঢলে পড়তে থাকে। আসর যখন ভাঙে, তখন ঘড়িতে প্রায় দু’টো। কেবিনে ফেরেন মুখ্যমন্ত্রীর অনুগতরা। কুয়াশা কাটতে কাটতে বুধবার সকাল সাড়ে ন’টা গড়িয়ে যায়। তখনও অবশ্য ক্লান্তি কাটেনি সওয়ারিদের। বেলা ১২টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী ফিরে আসেন পরমহংসের ডেকে। আবার গানবাজনা (সঙ্গে তালে তালে পা দোলানোও), ব্যাডমিন্টন। এরই একফাঁকে পাঁচতারা মধ্যাহ্নভোজ আর শিল্প নিয়ে আলোচনা। সেই আলোচনায় অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীই ঠিক করে দেন কে, কোথায়, কী ভাবে, কত দিনে, কত টাকা বিনিয়োগ করবেন। শিল্পপতিদের সকলেই তাতে সায় দেন।

এটা কী রকম হল? এক শিল্পপতির কথায়, “উপায় ছিল না। এমনিতেই সারারাত নদীতে আটকে থেকেছি। সহমত না হলে কী হতো কে জানে!”

প্রথমে ঠিক ছিল সুন্দরবনের কোর এরিয়া ঘুরে মঙ্গলবার সন্ধেয় সজনেখালিতে ফিরবে পরমহংস। পরের দিন গদখালি হয়ে সড়কপথে কলকাতা। কিন্তু নদীতে নেমে মুখ্যমন্ত্রীর সাধ হয়, জাহাজে চড়েই কলকাতা ফিরবেন। নামখানা থেকে কলকাতা যেতে লাগার কথা অন্তত আট ঘণ্টা। এ দিকে, রাক্ষসখালিতে আটকে পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর জাহাজ। সেখান থেকে নামখানাই হেসেখেলে ঘণ্টা দেড়েক। ফলে সব রুটিন ঘেঁটে একশা।

তবে নদীবক্ষে রাত্রিবাসের সম্ভাবনায় মমতা ও তাঁর দলবল যতটা হইহই করে উঠেছিলেন, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ব্যাপারটা হয়তো এতটা আহ্লাদের নয়। বিশেষ করে প্রশ্নটা যেখানে একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার। কলকাতা বন্দরের মেরিন বিভাগের এক কর্তার কথায়, “ভয়ঙ্কর কাণ্ড! ওই পথে জাহাজ চলাচল করে না বলে ওখানকার নদীর অবস্থা নিয়ে কোনও প্রামাণ্য সমীক্ষা নেই। কেন মুখ্যমন্ত্রীর জাহাজ ও-পথে চালিয়ে ঝুঁকি নেওয়া হল, বোধগম্য হচ্ছে না।”

এই ‘ঝুঁকি’র কাজটা যে সব আমলার নেতৃত্বে হয়েছে, তাঁদেরই এক জনের সঙ্গে কথা হল পরে। ভদ্রলোক রসিক। বললেন, “যাত্রাদলের অধিকারী কি যাত্রাদলের মালিক হন? যতই তিনি নিয়ন্ত্রকের ভাব করুন, দল মালিকের ইচ্ছাতেই চলে। তা সে সুন্দরবন হোক বা নবান্ন!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement