হিমালয়ে হারালেন পর্বতকন্যা

কাঞ্চনজঙ্ঘায় তুষারধসের কবলে ছন্দা

দুই বাঙালি মেয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা ছোঁয়ার খবরে মঙ্গলবারই আনন্দে মেতেছিল রাজ্য। কিন্তু তখনও কেউ জানতে পারেনি, কয়েক ঘণ্টা আগেই তুষার ধসের মুখে পড়েছেন সেই দুই মেয়েরই এক জন। এভারেস্ট জয়ী ছন্দা গায়েন। একটা দিন পেরোনোর আগেই উৎসবের মেজাজ ঢেকে গিয়েছে উৎকণ্ঠায়। এখনও খোঁজ নেই ছন্দার। শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শৃঙ্গ (কাঞ্চনজঙ্ঘা মেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটি শৃঙ্গের সর্বোচ্চ) ছুঁয়েই চড়াই ভাঙা শেষ হয়নি।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৪ ০৩:২৮
Share:

গত বছর এবিপি আনন্দর সেরা বাঙালির পুরস্কার হাতে ছন্দা গায়েন। —ফাইল চিত্র

দুই বাঙালি মেয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা ছোঁয়ার খবরে মঙ্গলবারই আনন্দে মেতেছিল রাজ্য। কিন্তু তখনও কেউ জানতে পারেনি, কয়েক ঘণ্টা আগেই তুষার ধসের মুখে পড়েছেন সেই দুই মেয়েরই এক জন। এভারেস্ট জয়ী ছন্দা গায়েন।

Advertisement

একটা দিন পেরোনোর আগেই উৎসবের মেজাজ ঢেকে গিয়েছে উৎকণ্ঠায়। এখনও খোঁজ নেই ছন্দার।

শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শৃঙ্গ (কাঞ্চনজঙ্ঘা মেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটি শৃঙ্গের সর্বোচ্চ) ছুঁয়েই চড়াই ভাঙা শেষ হয়নি। রবিবার সেই শৃঙ্গ জয় করার পরে কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম দিকের শৃঙ্গটিও (৮,৫০৫ মিটার) জয় করার পরিকল্পনা নিয়ে সোমবারই ছন্দা ফের বেরিয়ে পড়েছিলেন সামিট ক্যাম্প থেকে। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়ায় চুড়োর মাত্র কয়েকশো মিটার আগে ফেরার পথ ধরেন তিনি এবং তাঁর তিন সঙ্গী। সেই ফিরতি পথেই তুষার ধসের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন ছন্দা। নিখোঁজ তাঁর সঙ্গী দুই শেরপা পেমবা ও দাওয়া-ও। কোনও মতে বেঁচে ফিরেছেন তৃতীয় শেরপা তাশি।

Advertisement

কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম শৃঙ্গে পৌঁছনোর পথটির নাম ইয়ালুং কাং। সংকীর্ণ পথ ধরে এক পা-এক পা করে এগোতে হয়। দু’দিকে গভীর খাদ। সেই কার্যত অসম্ভবের পথই বেছে নিয়েছিলেন ছন্দা। কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শৃঙ্গ থেকে নেমে সামিট ক্যাম্পে ফেরার পর টুসি দাস, দীপঙ্কর ঘোষ ও রাজীব ভট্টাচার্যরা বেস ক্যাম্পে নামতে শুরু করেছিলেন। অন্য দিকে পূর্ব পরিকল্পনা মতোই তিন জন শেরপাকে নিয়ে পশ্চিম শৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন ছন্দা।

অসামরিক উদ্যোগে এখনও অবধি কোনও ভারতীয় পা রাখেননি ইয়ালুং কাং-এর পথে। মেয়েরা তো বটেই, তামাম বিশ্বের আরোহীরাও চট করে পা বাড়ানোর সাহস রাখেন না পশ্চিম শৃঙ্গের এই বিপদসঙ্কুল পথে। ৩৩ বছরের ছন্দা বরাবরই ব্যতিক্রমী। বিপদের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করে বারবার নিজের ক্ষমতাটা পরখ করে নেওয়াই তাঁর নেশা। গত বছর এভারেস্ট জয় করেই যেমন বেরিয়ে পড়েছিলেন লোৎসে-র উদ্দেশে, এ বারও তার অন্যথা হয়নি।

ছন্দার অভিযানের ব্যবস্থাপক নেপালের পর্বতারোহণ সংস্থা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা বেস ক্যাম্প সূত্রের খবর, ছন্দারা চার জন দু’টো দলে ভাগ হয়ে এগোচ্ছিলেন। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাশি। এই দলে তিনিই অভিজ্ঞতম। তিনি ছিলেন একটা আলাদা দড়িতে। বাকি তিন জন প্রায় ২০০ মিটার লম্বা অন্য একটা দড়িতে নিজেদের বেঁধেছিলেন। পাহাড়ে চড়ার নিয়ম অনুযায়ী, দড়ির একেবারে সামনে থাকেন বেশি অভিজ্ঞ আরোহী। কম অভিজ্ঞ যিনি, মাঝে থাকেন। সেই মোতাবেকই দড়ির সামনে ছিলেন মিংমা পেমবা শেরপা, পিছনে দাওয়া ওয়াংচুক। মাঝে ছন্দা। এ ভাবে দড়ির সঙ্গে বাঁধা থাকলে এক জন সদস্য যদি দৈবাৎ ‘ফল’ করেন (পড়ে যান) এবং ‘আইস অ্যাক্স’ (তুষার গাঁইতি) দিয়ে বরফে ঘা মেরে নিজেকে ‘অ্যারেস্ট’ করতে (পড়ে যাওয়া আটকাতে) না-পারেন, তবে অন্য সদস্যদের চেষ্টায় ‘অ্যারেস্ট’ হবেন তিনি। দড়িতে ঝুলে থাকবেন।

সামিট ক্যাম্প থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম শৃঙ্গ ছুঁতে গেলে প্রায় ১৭-১৮ ঘণ্টার লম্বা পথ পেরোতে হয়। এভারেস্ট অভিযানের ক্ষেত্রে সামিট ক্যাম্প থেকে শৃঙ্গের এই দূরত্ব ১০-১২ ঘণ্টার। সাধারণত শৃঙ্গের যতটা সম্ভব কাছেই সামিট ক্যাম্প ফেলা হয়। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘায় পাহাড়ের গা এতটাই খাড়া যে, শৃঙ্গ থেকে কম করে ১৭-১৮ ঘণ্টার দূরত্ব ছাড়া তাঁবু ফেলার উপযুক্ত জায়গাই নেই। সে মূল শৃঙ্গের ক্ষেত্রেও যা, পশ্চিম শৃঙ্গের ক্ষেত্রেও তাই।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

কাঞ্চনজঙ্ঘা পশ্চিম শৃঙ্গের রাস্তা অর্থাৎ ইয়ালুং কাং-এর শেষের দিকে অনেকটা পথ সংকীর্ণ ‘রিজ’ বা শৈলশিরা ধরে হাঁটতে হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার বেস ক্যাম্প (৫১৪৩ মিটার) থেকে আরোহী দলের অন্যতম সদস্য রাজীব ভট্টাচার্য বুধবার স্যাটেলাইট ফোনে বলছিলেন তাশির মুখ থেকে শোনা কাহিনি। এমনিতে মে মাসের এই সময়টা পর্বতাভিযানের পক্ষে অনুকূলই থাকে। তাশি ওঁদের জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে পশ্চিম শৃঙ্গের খুব কাছেই পৌঁছে গিয়েছিলেন ওঁরা। ছন্দার স্বপ্ন প্রায় সত্যিই হতে চলেছিল। কিন্তু বাদ সাধল খারাপ আবহাওয়া। দলনেতা তাশি সিদ্ধান্ত নেন, ফিরতে হবে। অগত্যা খুব কাছে গিয়েও শৃঙ্গ না ছুঁয়েই ফেরার প্রস্তুতি নেন সকলে। ফিরতি পথ ধরে নামতে শুরুও করেন। কিন্তু সামিট ক্যাম্পে পৌঁছনোর কিছু আগেই ঘটে দুর্ঘটনা।

যেখানে ছন্দারা নিখোঁজ হয়েছেন, পাহাড়ি পরিভাষায় সেই জায়গাটি ইয়ালুং কাং-এর ‘গ্রেট শেল্ফ’ বলে পরিচিত। প্রায় সাড়ে সাত হাজার মিটার উচ্চতায় লম্বাটে একটা তাকের মতো জায়গা। একটা বড়সড় খাঁজ, যার নীচের দিকটা খাড়া নেমে গিয়েছে। শেষ দেখা যায় না। উপরের দিকে শৃঙ্গের হাতছানি। তাশি বেস ক্যাম্পে ফিরে দলের সকলকে জানিয়েছেন, ওই শেল্ফ-এই হঠাৎ উপর থেকে তুষার ধস নেমে আসতে দেখা যায়। তাশি চিৎকার করে সাবধান করে দেন বাকিদের। ছোট-বড় তুষার ধস ইয়ালুং কাং-এর ওই রুটে অপরিচিত নয়। এ-দিক ও-দিক সরে গিয়ে তুষার ধসের সোজাসুজি পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারলেই কান ঘেঁষে বেরিয়ে যায় বিশাল ওই তুষার-পিণ্ড।

কিন্তু সেটাই আর হয়ে উঠল না এ বার। রাজীবের মুখ থেকে শোনা তাশির বয়ান অনুযায়ী, তাড়াতাড়ি সরতে গিয়ে পড়ে যান ছন্দা। অনেকটা পড়ার পরেও আইস অ্যাক্স-এর সাহায্যে সেই ‘ফল’ অ্যারেস্ট করে ফেলেন পেমবা শেরপা। ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ফের উঠে দাঁড়ান ছন্দা। কিন্তু ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ফের নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে যে সময়টা খরচ হয়ে যায়, ধাবমান ধসের সামনে থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার ফুরসতটুকু তাতে আর মেলেনি। তাশির চোখের সামনেই ছন্দাদের তিন জনকে নিয়ে ওলোটপালোট খেতে খেতে মিলিয়ে যায় তুষার ধসটা। নীচের দিকে শুধু সাদা ধোঁয়া আর তুষারগর্জনের সঙ্গে মিশে থাকা তিন জনের চিৎকার।

গ্রেট শেল্ফ থেকে বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন তাশি। একা, বিধ্বস্ত। মাঝে কেটে গিয়েছে প্রায় ২৪ ঘণ্টা। খবর আসে সমতলে। ছন্দার অভিযান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল নেপালের যে সংস্থা, তার কর্ণধার মিংমা শেরপা। তিনি দাবি করছেন, খবর পেয়েই কাঠমাণ্ডু থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হেলিকপ্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কিন্তু বুধবার বিকেল পর্যন্ত বেসক্যাম্প সূত্রের খবর, হেলিকপ্টার পৌঁছয়নি। তা ছাড়া সাধারণ ভাবে ছ’হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় হেলিকপ্টার পৌঁছতে পারে না বলেও জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশ্য নেপাল সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ রাখছে।

নবান্ন সূত্রের খবর, রাজ্যের হাতে উপযুক্ত বিপর্যয় মোকাবিলা দল না-থাকায় দার্জিলিঙের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের একটি দলকে পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছে। আজ, বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসুর বক্তব্য, বাংলার পরিচিত অভিযাত্রীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকাজ তদারকি করলে ভাল হয়। “এখন এক-একটা ঘণ্টাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি গাফিলতির কারণে সেটা নষ্ট হচ্ছে,” মন্তব্য অনিমেষবাবুর।

এভারেস্ট এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করা পর্বতারোহী বসন্ত সিংহরায় জানাচ্ছেন, ২০১১ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ইয়ালুং কাং-এর বিপদসঙ্কুল পথ। ওই উচ্চতায় তুষার ধস বা অ্যাভালাঞ্চের মুখে পড়া মানে তা প্রায় মৃত্যুরই সামিল, বলছেন বসন্তবাবু। “সরু রিজ দিয়ে একটা একটা করে পা ফেলে এগোতে হয়, তুষার ধস নামলে সরার জায়গাই বা কোথায়?” গলা ধরে আসে বসন্তর। প্রিয় ছাত্রী ছন্দাকে প্রথম থেকেই যথাসাধ্য গাইড করেছিলেন তিনি। বললেন, “মেয়েটাকে কত বার যে বারণ করেছিলাম, পরপর দু’টো শৃঙ্গ জয়ের সিদ্ধান্ত না নিতে...ওর জেদ ওকে সারা বিশ্বে চিনিয়েছে, ওর জেদই এই বিপদ ডেকে আনল।”

তবে অলৌকিক ঘটনাও তো ঘটে। ঘটেছে আগেও একাধিক বার। গত বারই ধবলগিরি শৃঙ্গ অভিযানে গিয়ে নিজেও তুষার-ঝড়ের মুখে পড়েন বসন্ত সিংহরায়। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় প্রায় আট হাজার মিটার উচ্চতায় খোলা আকাশের নীচে কাটানোর পর জীবিত উদ্ধার করা গিয়েছিল তাঁকে।

১৯৮০ সালে হিমাচলপ্রদেশের হনুমান টিব্বা অভিযানে তুষার ধসে চাপা পড়েছিলেন মানালির অভিযাত্রী মহাবীর ঠাকুর। তাঁর কথায়, “মুহূর্তের জন্য মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। ঠিক কোন ক্ষমতায় যে বরফের মধ্যে হাত-পা চালিয়ে নিজেকে বার করতে পেরেছিলাম, তা বলতে পারি না।” তবে সে ক্ষেত্রে উচ্চতা ছিল পাঁচ হাজার মিটারের কাছাকাছি।

প্রায় সাড়ে সাত হাজার মিটার উচ্চতায় ছন্দার সঙ্গে কি তেমন অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে? মিংমা শেরপা বহু বার সামলেছেন এ ধরনের পরিস্থিতি। হেলিকপ্টার পাঠিয়ে কখনও উদ্ধার করতে পেরেছেন আরোহীদের, কখনও পারেননি।

ছন্দা ফিরবেন, এখনও আশায় বুক বেঁধে শুভানুধ্যায়ীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement