ঘরোয়া আলাপচারিতায় তিনি যে সব সময় খুব ব্যাকরণ মেনে কথা বলেন, তা নয়। কিন্তু প্রকাশ্য অন্তত তার কোনও বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত না। এত দিন পর্যন্ত! সেই আগলটাই এ বারে ভেঙে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গত কয়েক দিনে একাধিক সভায় এমন একাধিক শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন, যা আপত্তিকর তো বটেই, কিছু ক্ষেত্রে অশালীনও। তীব্র সমালোচনার মুখে কখনও কখনও সে সবের জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেও এখন কিন্তু এমন ভাষা বলার জন্য যুক্তি সাজাতেও দ্বিধা করছেন না তৃণমূল নেত্রী! আর এ সব থেকে স্পষ্ট, চাপে দিশাহারা হয়েই এমন করছেন মমতা। এমন ঘটনা আবারও ঘটতে পারে বলে মনে করছেন তাঁর দলেরই অনেকে।
ভাষার আগল ভাঙার শুরুটা হয়েছিল সারদা-কেলেঙ্কারিতে দলের সাংসদ সৃঞ্জয় বসু গ্রেফতার হওয়ার পরে। কখনও ‘শালা’, কখনও ‘বাঁশ দেওয়া’, কখনও বা মুদ্রা সহযোগে ‘বাম্বু দেওয়া’র কথা বলেছেন বিভিন্ন সভায়! নবান্নে দাঁড়িয়ে বিজেপি নেতাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘তুই’ শব্দটিও বলে ফেলেন। তাঁর মুখে এ ধরনের মন্তব্য যে শোভন নয়, সেটা বুঝে শব্দ প্রত্যাহার করে দুঃখপ্রকাশও করেছেন কখনও কখনও। কিন্তু কুকথার স্রোত থামেনি। তবে ‘শালা’ বা ‘বাঁশ’ নয়, মুখ্যমন্ত্রী এখন ‘বাম্বু’ (বাঁশ)-র ব্যবহার নিয়েই বেশি সরব! তাঁর ঘনিষ্ঠ মদন মিত্র গ্রেফতারের পরে শনিবার ক্রীড়াবিদদের মিছিলে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য, “ভারতবর্ষের দুনিয়ায় যারা সৎ ভাবে রাজনীতি করতে চায়, তাদের পিছনে বাম্বু দেওয়ার অধিকার তোমাদের যদি থাকে, গণতন্ত্রের কথা বলার অধিকারও আমাদের আছে!”
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য শুনে বিজেপি নেতা তথাগত রায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মানুষকে খুব বোকা মনে করেন। তাই অশালীন কথাও বললেন, আবার আইনও বাঁচালেন!” কিন্তু কেন এমন বলছেন মমতা? তথাগতর ব্যাখ্যা, “আসলে যাঁরা জেলে ঢুকেছেন, তাঁরা কী না কী প্রকাশ করে দেবেন, এই ভেবে মুখ্যমন্ত্রী ভীষণ ভয় পেয়েছেন। সে জন্যই এ সব বলছেন।” এক কংগ্রেস নেতার কথায়, “একেবারে মণিমুক্তোর ছড়াছড়ি!”
শুধু ‘বাম্বু’ নয়, এ দিনের সভায় একাধিক এমন মণিমুক্তো ছড়িয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, “সরকার হিসেবে এখানে আসিনি। নাগরিক হিসেবে এসেছি। এই পজিশনে না থাকলে বলতাম, জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব! কিন্তু এই পজিশনে আছি বলে বলছি না!” একই সঙ্গে সিবিআইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, “সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে তুমি সিবিআই কী করছিলে? লবেঞ্চুস খাচ্ছিলে? রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার চুরি হয়ে গেল, তোমরা (সিবিআই) বললে, আমি করতে পারব না। নেকাচণ্ডী!”
কলকাতার সভায় ‘শালা’ বলে ক্ষমা চাইলেও এ দিন তিনি কিন্তু এই সব শব্দ ব্যবহারের পিছনে যুক্তি সাজিয়েছেন! বলেছেন, “এ সব কথা দুঃখে বেরিয়ে আসে, ধিক্কারে বেরিয়ে আসে, যন্ত্রণায় বেরিয়ে আসে!” এ সব কথা বললেও তাঁর এই ভাষা প্রয়োগ নিয়ে যে নিন্দার ঝড় উঠেছে, তা বিলক্ষণ জানেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই এ দিন সমালোচকদের উদ্দেশে তাঁর কটাক্ষ, “কেউ কেউ আবার ভাষা নিয়ে বলছে! সবাই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাষায় কথা বলছে তো! কথামৃতের ভাষা!”
মমতার ‘কথামৃত’ শুনে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “বাড়ির বাচ্চাদের টিভিতে আর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শোনা উচিত নয়। তা হলে তারা অন্ধকার জগতের অপভাষা (স্ল্যাং) শিখে যাবে।” এক ধাপ এগিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “মমতার কথামৃত, অভিধান সবই ওঁর নিজস্ব প্রোডাক্ট! এর ব্যবহার অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী তো করেন না!” আর তৃণমূলের নেতারা? তাঁদের অনেকেই দলনেত্রীর এমন মন্তব্যে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে। একান্তে বলছেন, এই ধরনের কথা না বললেই ভাল হতো। এ সব বলে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন মমতা।