একটি দেহ নদীতে ফেলে গাড়ি দেখেই ছক বদল

খুন করার পর বাঙালি তরুণ-তরুণীর দেহ দু’টি চকরাতার কাছে যমুনা সেতুর উপর থেকে খরস্রোতা নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল দুষ্কৃতীদের। সেই মতো তরুণীটির দেহ জলে ফেলার পরেই উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখতে পায় তারা। ঝটিতি ছক বদলায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১০
Share:

এই সেতু থেকেই ছুড়ে ফেলা হয় অভিজিতের দেহ।

খুন করার পর বাঙালি তরুণ-তরুণীর দেহ দু’টি চকরাতার কাছে যমুনা সেতুর উপর থেকে খরস্রোতা নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল দুষ্কৃতীদের। সেই মতো তরুণীটির দেহ জলে ফেলার পরেই উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখতে পায় তারা। ঝটিতি ছক বদলায়। বাঙালি তরুণ অভিজিৎ পাল (২৪)-এর দেহ নিয়ে ফের রওনা হয় গাড়ি। অনেকটা দূরে গিয়ে নির্জন পাহাড় থেকে খাদে ছুড়ে ফেলা হয় অভিজিতের দেহ। ট্যাক্সিচালক রাজু দাস-সহ ধৃত চার জনের বয়ান থেকে এমনটাই জানা গিয়েছে বলে বুধবার দাবি করল উত্তরাখণ্ড পুলিশ।

Advertisement

অভিজিতের মৃতদেহ উদ্ধার হলেও তাঁর বান্ধবীর দেহের কোনও খোঁজ এখনও মেলেনি। পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় রোজই বিভিন্ন জায়গায় নদীর ধার থেকে মহিলার মৃতদেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে তারা ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু গিয়ে দেখা যাচ্ছে তা এই বাঙালি তরুণীর দেহ নয়। তরুণীটির আত্মীয়-বন্ধুরা দেহ পাওয়ার আশায় এখনও বসে আছেন উত্তরাখণ্ডে। তাঁদের অভিযোগ, অভিজিতের দেহ পাওয়ার পরে শনাক্তকরণের জন্য বাড়ির লোকেদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি স্থানীয় পুলিশ। ময়না-তদন্তের পর দেহটির সৎকার করে ফেলেছে তারা। তরুণীটির ক্ষেত্রে যাতে তা না হয়, সে জন্য উত্তরাখণ্ডেই তাঁরা অপেক্ষা করবেন বলে আত্মীয়রা জানিয়েছেন।

উত্তরাখণ্ড পুলিশের দাবি, বাবলু নামে ধৃত চার যুবকের একজন খুনের আগে তরুণীটির উপরে অত্যাচার চালিয়েছিল। উত্তরকাশীর পুলিশ সুপার জগৎরাম জোশীর কথায়, “ধৃতদের বয়ান থেকে আমরা পুরো বিষয়টি জানতে পেরেছি। তরুণ-তরুণীকে আলাদা জায়গায় খুন করা হয়েছে। খুনের আগে তরুণীর উপরে অত্যাচার চালানো হয়েছে। ধৃতেরা অপরাধ কবুল করেছে।”

Advertisement

পুলিশ জানাচ্ছে, গত ২২ অক্টোবর রাতে অভিজিৎ ও তাঁর বান্ধবী চকরাতায় ছিলেন। ২৩ তারিখ রাজুর গাড়িতে করে তাঁরা ঘুরতে বেরোন। পাঁচ কিলোমিটার দূরে টাইগার ফলসে যান তাঁরা। সেখান থেকেই রাজু তার তিন সঙ্গীকে গাড়িতে তোলে। গাড়িটির ফেরার কথা ছিল চকরাতায়। কিন্তু, সেই রাস্তা ছেড়ে রাজু লাখামণ্ডল নামে অন্য একটি এলাকার দিকে রওনা হয়। পথে কোয়াসি ও লাখামণ্ডলের মাঝখানে নির্জন রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দু’জনের সর্বস্ব কেড়ে নেয় চারজন। গাড়ির ভিতরেই একজন তরুণীটিকে চেপে ধরে। অন্য তিনজন অভিজিতের গলায় মাফলার জড়িয়ে তাঁকে খুন করে। অভিজিতের দেহ গাড়ির পিছনের আসনে ফেলে তারই পাশে তরুণীটিকে বসিয়ে রাখা হয়। গাড়ি ফের চলতে থাকে।

উত্তরাখণ্ড পুলিশের অভিযোগ, এর পরে আরও দু’কিলোমিটার গিয়ে গাড়ি দাঁড় করায় রাজু। সেই সময়েই তরুণীটির উপরে পৈশাচিক অত্যাচার করে বাবলু। তার পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে খুন করা হয় তাঁকেও। দু’টি দেহ নিয়ে গাড়ি এগোয় যমুনা সেতুর দিকে। তত ক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। সেই সেতু থেকে তরুণীটির দেহ জলে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু অভিজিতের দেহ ফেলার আগেই এসে পড়ে আরও একটি গাড়ি। অন্য গাড়ির হেডলাইট দেখে অভিজিতের দেহ নিয়ে সেখান থেকে নিয়ে সরে পড়ে রাজুরা। যমুনা সেতু থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে নৌগাঁও এলাকায় খাদে ফেলে দেওয়া হয় অভিজিতের দেহ। যে দেহ কিছু দিন আগে উদ্ধার করেছিল পুলিশ।

কিন্তু শনাক্তকরণের আগেই কেন সেই দেহের সৎকার করে ফেলা হল? কেন অপেক্ষা করা হল না পরিবারের জন্য? উত্তরকাশীর পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যা, “আমরা ৩০ অক্টোবর মৃতদেহটি পাই। তখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে ওই তরুণ-তরুণীর নিখোঁজ হওয়ার কোনও খবর ছিল না।” অভিজিতের আত্মীয়-বন্ধুরা এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, ২৮ অক্টোবর দিল্লির সাকেত থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছিল। চকরাতা থেকেই যে শেষ বারের মতো ওঁরা দু’জন নিজেদের বাড়িতে ফোন করেছিলেন, তা-ও জানানো হয়েছিল পুলিশকে। বস্তুত, অভিজিৎ এবং তরুণীটির আত্মীয়-বন্ধুরা একই সুরে অভিযোগ তুলেছেন যে, প্রথম থেকেই উত্তরাখণ্ড পুলিশ ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বিশেষত, রাজুকে যে ভাবে তারা এক বার হাতে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিল, তার পর উত্তরকাশীর পুলিশ সুপারের কথায় ভরসা রাখা যায় না।

নিহতদের পরিজনদের মতে, দিল্লি পুলিশ বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হওয়ার ফলেই অভিযুক্ত চার জনকে গ্রেফতার করা গিয়েছে। রাজু যে গোটা ঘটনার মাথা, তা দিল্লি পুলিশই উত্তরাখণ্ড পুলিশকে জানায়। তার ভিত্তিতেই চার জনকে গ্রেফতার করে উত্তরাখণ্ড পুলিশ। তরুণীটির পরিবারের ক্ষোভ, পুলিশ আগে সক্রিয় হলে হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত তাঁদের মেয়ের মৃতদেহ। ওই দেহ উদ্ধারে এখনও পর্যন্ত কোনও তল্লাশি অভিযান হয়নি। তবে উত্তরকাশীর পুলিশ সুপার বুধবার জানিয়েছেন, দেহরাদূন থেকে বৃহস্পতিবার সকালে বিশেষ একটি তদন্তকারী দল পৌঁছবে চকরাতা। তারাই নদী বরাবর তল্লাশি চালাবে।

কী ভাবে উত্তরাখণ্ড পুলিশ তাঁদের সঙ্গে ‘অসহযোগিতা’ করেছে, বুধবার তার বিবরণ দিচ্ছিলেন তরুণীটির কাকা। তিনি বলেন, ভাইপোকে নিয়ে ২ নভেম্বর সন্ধ্যায় তাঁরা দেহরাদূন পৌঁছন। পরের দিন ভোরে বিকাশনগর হয়ে চকরাতা পৌঁছোন তাঁরা। অভিজিৎরা যে হোটেলে উঠেছিলেন সেখানেই প্রথমে যান তাঁরা। সেখানে কোনও খোঁজ না পেয়ে যান বিকাশনগর থানায়। সেখানকার পুলিশ জানায়, ওই এলাকায় কোনও দুর্ঘটনা বা অন্য কোনও ঘটনার কথা তাদের জানা নেই। দু’তিন দিন ধরে আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরের হোটেলের ভিজিটর্স বুক পরীক্ষা করে দেখেন তরুণীর কাকা। এ কাজে স্থানীয় এক বিজেপি বিধায়কও তাঁদের সাহায্য করেন। কিন্তু দু’জনের সন্ধান মেলেনি।

তরুণীর কাকার অভিযোগ, বিকাশনগর থানার পুলিশের হাবভাব তাঁদের ভাল লাগেনি। তিনি বলেন, “প্রথম থেকেই রাজুকে গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছিলাম। উত্তরাখণ্ড পুলিশের একাংশের চাপে রাজুকে বিকাশনগর থানায় ডেকে পাঠানোও হয়েছিল। কিন্তু সেখানে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেয়।” তাঁর দাবি, রাজুকে জিজ্ঞাসাবাদের কিছু অংশের মোবাইল রেকর্ডিং তাঁদের কাছে আছে। তা শুনলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজুকে ধরার পরেই জাল খুলেছে রহস্যের।

পর্যটক-ট্যাক্সির ভাবনা কেন্দ্রের

পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নতুন ধরনের ট্যাক্সির কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় সরকার। পর্যটকদের জন্য বানানো এই ট্যাক্সিতে থাকবে একটি নয়া বৈদুতিন চিপ। বুধবার কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী মহেশ শর্মা এ কথা জানিয়েছেন। দেহরাদূনে দুই বাঙালি পর্যটকের খুনের ঘটনার পরই সরকারের এই ভাবনা। মহেশ শর্মা জানান, নতুন এই চিপটি ট্যাক্সিতে লাগানো হলে পুলিশ ট্যাক্সির গতিবিধি জানতে পারবে। তিনি আরও জানান, এখনই সব ট্যাক্সিতে লাগানো হবে না এই চিপ। তাই পর্যটকেরা বিমানবন্দরে এসে চিপ ছাড়া ট্যাক্সিও পাবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement