আবার তিনি ‘বন্ধু’ হলেন। মাসখানেক বাদে হয়তো সহযাত্রীও হবেন ঢাকাগামী বিমানে। একদা দলের সাংসদ, পরে অনেকটাই দূরে সরে যাওয়া সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমনকে আসন্ন বাংলাদেশ সফরে সরকারি প্রতিনিধি দলে যোগ দিতে ডাক দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শিল্পী নিজে অবশ্য দাবি করেছেন, এ বিষয়ে এখনও কেউ তাঁকে কিছু জানাননি। তবে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রে মমতার সম্ভাব্য সফর-সঙ্গীদের যে তালিকা বৃহস্পতিবার পাওয়া গিয়েছে, তাতে উল্লেখযোগ্য নাম কবীর সুমন। সেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে মমতার পাশে তাঁকে দেখা গেলেও যিনি বাম আমলের শেষ লোকসভা ভোটের বছরখানেক পর থেকেই নেত্রীর কাছে কার্যত অচ্ছুত হয়ে ছিলেন। তা হলে কেন এই আকস্মিক পরিবর্তন?
তৃণমূল সূত্রের খবর, ইদানিং কালে বিজেপির সঙ্গে রাজ্যের শাসক দলের রাজনৈতিক চাপানউতোরের আবহে বিভিন্ন সভা-অনুষ্ঠান বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সুমনের অবস্থান বিলক্ষণ মনে ধরেছে নেত্রীর। ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সুমনের বক্তব্য হাতিয়ার হতে পারে বলে তৃণমূল নেতৃত্বও মনে করছেন। সুমনকে অবশ্য প্রকাশ্যে তৃণমূলের কোনও মিটিং-মিছিলে এখনও দেখা যায়নি। কিন্তু, তৃণমূলকে রাজনৈতিক ভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি এ কথা ইদানিং বার বারই বলে আসছেন শিল্পী। সুমন প্রসঙ্গে সরাসরি মুখ খুলতে না-চাইলেও তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, “সংস্কৃতি জগতের প্রতিবাদী মুখ হিসেবেই ওঁকে তখন দলের দরকার ছিল। এখনও বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওঁর মতের সঙ্গে দলের অবস্থান মিলে যাচ্ছে।”
ফলে, এ যাবৎ বিভিন্ন বিষয়ে দলের সঙ্গে তাঁর মতান্তর বা মনান্তর এখন আর মনে রাখছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূলের টিকিটে জিতে সাংসদ হলেও দলের নীতি অপছন্দ হলে কখনওই প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে পিছপা হননি সুমন। সাংসদ হিসেবে কাজ করতে দলের কিছু নেতা নানা ভাবে বাধা সৃষ্টি করছে বলে গত বিধানসভার ভোটের আগেই সুমন সরব হন। সুমন-মমতা সম্পর্ক কার্যত তলানিতে ঠেকে। এবং মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড, অম্বিকেশ মহাপাত্র বা শিলাদিত্যের ঘটনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে বার বারই নেত্রীর ভূমিকার কড়া নিন্দা করেছেন সুমন, কখনও বা প্রতিবাদী গানও বেঁধেছেন। তবে প্রতিবাদ করলেও সুমন সাংসদ পদ বা তৃণমূল ছাড়েননি। মমতাও তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করেননি। কিন্তু গত লোকসভা ভোটের আগে সুমনকে প্রার্থী করার জন্য তিনি যাদবপুরের ভোটারদের কাছে কার্যত ক্ষমাই চেয়েছেন। এখন বিজেপি-বিরোধিতার আবহে মমতা সেই সুমনের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে ইচ্ছুক বলে ইঙ্গিত মিলেছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, বাংলাদেশে সুমনের গানের জনপ্রিয়তাও মাথায় রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বা একুশে ফেব্রুয়ারি, শাহবাগের গণজাগরণ নিয়ে সুমনের বেশ কিছু গান রয়েছে। এ সব দিক মাথায় রেখেই ভাষা দিবসের প্রাক্কালে পড়শি দেশে গুরুত্বপূর্ণ সফরে সুমনকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছেন মমতা।
প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের নির্দেশমাফিক তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের তরফে এ দিনই সম্ভাব্য সফরসঙ্গীদের তালিকা প্রস্তুত করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। এ বিষয়ে সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য শুধু বলেন, “আমাকে কেউ এখনও এ বিষয়ে কিছু বলেননি।” শিল্পীর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, ব্যক্তিগত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি হয়ে ঢাকায় যেতে তাঁর খুবই আগ্রহ আছে। তবে সুমন কিছুটা অসুস্থ। মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হলে প্রোটোকল মাফিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে। শারীরিক ভাবে এই ধকল নেওয়াটা কত দূর ঠিক হবে, তা নিয়ে শিল্পী নিজেই কিছুটা সন্দিহান।
সুমন ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের তালিকায় অবশ্য চমক নেই বললেই চলে। এমনিতে সাংসদদের মধ্যে টলি-তারকা দেব প্রমুখ থাকতে পারেন। রাজনীতির মুখের বাইরে আর বলার মতো নাম প্রসেনজিৎ। মমতার সফরের সময়ে বাংলাদেশেই গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’-এর শু্যটিংয়ে তাঁর ব্যস্ত থাকার কথা। তিনি বলেন, “বিনোদনের দুনিয়ায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের যোগাযোগ বাড়ানোয় আমি বিশেষ ভাবে আগ্রহী। মুখ্যমন্ত্রীর সফরে থাকতে পারলে খুব ভাল লাগবে।” শিল্পপতিদের মধ্যে নাম আছে সঞ্জীব গোয়েনকা, হর্ষ নেওটিয়াদের। হর্ষ এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার এ বিষয়ে আগে কথা হয়েছিল। তবে ওই সময়ে হার্ভার্ডে আমার কিছু কাজ থাকবে। সম্ভবত আমি যেতে পারব না।” এ ছাড়া, যাঁরা থাকছেন সেই শ্রীকান্ত মোহতা, ইন্দ্রনীল-নচিকেতা বা ভূমি-র গায়ক সৌমিত্র রায়কে তৃণমূলের বেশির ভাগ কর্মসূচিতেই দেখা যায়।