আশ্বাস দিয়েও অদৃশ্য কমিশন, শেষ দফাই সব চেয়ে রক্তাক্ত

প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ প্রতিফলন পড়ল না। সোমবার পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্বে মানুষ যাতে নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য রাস্তায় নেমে পরিস্থিতি মোকাবিলার আশ্বাস দিয়েও নির্বাচন কমিশন এ দিন অদৃশ্য রইল বহু জায়গায়। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের-ও অস্তিত্ব সে ভাবে টের পাওয়া যায়নি। দুইয়ে মিলে শেষ দফার ভোটেই রাজ্যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটল সর্বাধিক।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৪ ০৩:৩৩
Share:

প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ প্রতিফলন পড়ল না। সোমবার পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্বে মানুষ যাতে নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য রাস্তায় নেমে পরিস্থিতি মোকাবিলার আশ্বাস দিয়েও নির্বাচন কমিশন এ দিন অদৃশ্য রইল বহু জায়গায়। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের-ও অস্তিত্ব সে ভাবে টের পাওয়া যায়নি।

Advertisement

দুইয়ে মিলে শেষ দফার ভোটেই রাজ্যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটল সর্বাধিক।

যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় গুলি চলল। চার ভোটার আহত হলেন। বুথ দখলের সব চেয়ে বেশি অভিযোগ মিলেছে এ দিনই। সবই ঘটেছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও! বিস্তীর্ণ এলাকায় বিরোধী এজেন্টদের বুথ থেকে বার করে দেওয়ার অভিযোগ মিলেছে। তিন জায়গায় শাসকদলের নেতারা বুথে ঢুকে ভোট করিয়েছেন বলেও অভিযোগ। একটা সময়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, বেদি ভবনের ডেরা ছেড়ে বেরোতে বাধ্য হন রাজ্যে কমিশন-নিযুক্ত বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ। পাঁচ দফার মধ্যে এই প্রথম!

Advertisement

তত ক্ষণে অবশ্য সাত ঘণ্টা ভোট হয়ে গিয়েছে। ঘটেছে বিস্তর অশান্তি।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

পঞ্চম দফা নির্বাচনে বুথ দখল ও অশান্তি রুখতে রাস্তার নামার হুমকি দিয়েছিল যে সিপিএম, তাদেরও এ দিন বিশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেব ঘোষণা করেছিলেন, কোথাও বুথ দখল হলে, বা বৈধ ভোটার ভোট দিতে না-পারলে সিপিএম সমর্থকেরা রাস্তায় বসে পড়বেন। উত্তর ২৪ পরগনা জুড়ে থাকবে তাঁদের একশো নজরদারি ক্যামেরা। বাস্তবে এ দিন তা চোখে পড়েনি। উপরন্তু উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ অংশ ও বন্দর তল্লাটে দুপুরের পরে বহু বুথ থেকে সিপিএমের এজেন্টরা উধাও হয়ে যান। এমনকী, হাড়োয়ায় গুলিতে আহতদের নিজেদের ‘ঘরছাড়া সমর্থক’ হিসেবে অভিহিত করলেও তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি সিপিএমের কেউ। এ দিন রাজ্যে যে ১৭টি লোকসভা আসনে ভোট হল, সেখানে কংগ্রেস বা বিজেপি-র পক্ষেও প্রতিরোধের দেওয়াল তোলা সম্ভব ছিল না।

এবং অভিযোগ, সে ভাবে দেখা মেলেনি কমিশনেরও। ‘নিষ্ক্রিয়তা’র জন্য রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও) ও বিশেষ পর্যবেক্ষকের বিরুদ্ধে আগেই জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে নালিশ করেছিল বিরোধী দলগুলি। যার জেরে পঞ্চম দফায় অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানোর সঙ্গে কড়া নজরদারির প্রতিশ্রুতি দেয় কমিশন। কিন্তু শনিবার থেকে কলকাতা ও আশপাশের নানা ঘটনায় অশান্তির ইঙ্গিত মিলতে শুরু করে। কাশীপুরের ওসি যে ভাবে রবিবার হামলাকারীদের গ্রেফতারে গড়িমসি করেছেন, যে ভাবে এসি’র নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছেন, তাতেও বিভিন্ন মহলে প্রশাসনিক সক্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। এত সব পূর্বাভাস থাকতেও কমিশন এ দিন সকাল থেকে সে ভাবে সক্রিয় হলেন না কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

সুনীল গুপ্ত যদিও মনে করছেন, এ দিন ভোট প্রক্রিয়ায় সমস্যা হয়নি। তাঁর দাবি, যেখানেই সংঘর্ষ বা গণ্ডগোলের খবর মিলেছে, সেখানেই পুলিশ-প্রশাসন চটজলদি ব্যবস্থা নিয়েছে। এই দফা পরিচালনার জন্য সিইও নিজেকে কত নম্বর দেবেন? সুনীলবাবু প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছেন।

অন্য দিকে দিল্লিতে উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি-র বিশ্লেষণ, “রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংঘর্ষ, গোলমালের খবর এসেছে। বহু জায়গায় দলগুলি গোলমালে জড়িয়েছে। বেশ কিছু মানুষ আহত। তবে কোথাও প্রাণহানি ঘটেনি। প্রতিটি ঘটনায় কমিশন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে।” কিন্তু একাধিক বুথে গোলমালের আগাম আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কমিশন কেন তা রুখতে পারল না? কেনই বা বিশেষ পর্যবেক্ষক আগে বেরোলেন না? জুৎসি অবশ্য এ সব প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন থেকে উঠে চলে গিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ দফার ভোটের মতো পঞ্চম দফাতেও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। শুধু জেলায় জেলায় নয়, খাস মহানগরের সল্টলেক, রাজারহাট, যাদবপুরের মতো এলাকাতেও বিভিন্ন স্পর্শকাতর বুথে এ দিন বাহিনীর দেখা মেলেনি। কোথাও বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতেই বুথের মধ্যে পোলিং অফিসারের জায়গা নিয়েছেন শাসকদলের নেতা! যেমন কামদুনিতে। আবার কলকাতার বন্দর এলাকায় যখন ব্যাপক ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ উঠছে, তখন টহলদার কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দেখা গিয়েছে রাস্তার ধারে বিশ্রাম নিতে!

পুরো পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিরোধীরা আবার কমিশনের বিরুদ্ধে কোমর বাঁধছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটপর্বে রাকেশের সামগ্রিক ভূমিকা সম্পর্কে তদন্তের দাবি তুলেছে রাজ্য বিজেপি। “ওঁর সঙ্গে শাসকদলের কোনও গোপন বোঝাপড়া হয়েছে কি না, জাতীয় নির্বাচন কমিশন তা তদন্ত করে দেখুক,” বলছেন বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। বামেরাও কমিশনের ‘অসহযোগিতার’ প্রতিবাদে রাস্তায় নামার পরিকল্পনা করছে। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, ১৭ কেন্দ্রের প্রায় এক হাজার বুথে রিগিং ও ছাপ্পা ভোট হয়েছে। তাঁর কথায়, “যে সব বুথে গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে, সেখানে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে মঙ্গলবার সব জেলায় বিক্ষোভ, অবস্থান প্রতিবাদ করা হবে।” একই দাবিতে বুধবার বামেরা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। সিপিএমের অভিযোগ, এ দিন হামলায় তাদের দুই প্রার্থী ও ২২ সমর্থক আহত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে আছেন হাড়োয়ার গুলিবিদ্ধ চার জন। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কিছু বুথ, পানিহাটি, ক্যানিং পূর্বের কয়েকটি জায়গায় ফের ভোটের দাবি তুলেছে কংগ্রেস। দলের প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “এই ভোটটা তৃণমূলের কাছে মরণ-বাঁচনের লড়াই। সে জন্য ভোটকে কালিমালিপ্ত করতে তারা যা করল, তা অভূতপূর্ব।” শাসকদলের কী বক্তব্য?

ভোট নিয়ে বিরোধী দলগুলির সমালোচনার মুখে এ দিন ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সংবাদ মাধ্যমের একাংশের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে তিনি মর্মাহত। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের মন্তব্য, “এ দিন সকাল থেকে কিছু বৈদ্যুতিন মাধ্যম প্রচার করতে চেয়েছে যে, এখানে অবাধ ভোট হচ্ছে না। তা অসত্য।”

কিন্তু হাড়োয়া, বেলেঘাটা, কাশীপুর? মুকুলবাবুর ব্যাখ্যা, “৩১ হাজার ৩৯২টি বুথে ভোট হয়েছে। গোলমালের সব সংখ্যা যদি ধরি, তা হলে গোলমাল হওয়া বুথের সংখ্যা শতাংশের হিসেবেও আসে না!”

বস্তুত পঞ্চম দফার ভোটে রাজ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায়। সেখানে তৃণমূলের ছোড়া গুলি ও চপারে ১৮ জন সিপিএম কর্মী-সমর্থক জখম হন। তৃণমূলের দাবি: সিপিএমের আক্রমণে তাদেরও চার জন জখম হয়েছেন। গোলমালের জেরে ওই তল্লাটে সিপিএমের বহু কর্মী-সমর্থক ভোট দেননি। সিপিএমের অভিযোগ, মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডল ও তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের উপস্থিতিতেই এ দিন বন্দুক, চপার, তরোয়াল নিয়ে শাসকদলের দুষ্কৃতীরা হামলা চালায়। অভিযোগ, গুলি চলেছে তৃণমূলকর্মী উদয় মণ্ডলের বাড়ি থেকে। সেখানে তল্লাশির দাবি ওঠে। রাকেশের নির্দেশে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েও হাতিয়ার কিছু পায়নি। উদয়বাবুর দুই ছেলে দীপঙ্কর ও শুভঙ্করকে গ্রেফতার করা হয়। সিপিএমের তরফে ঊষারানি ও তাঁর স্বামী-সহ ২৭ জনের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

এ ছাড়া গোলমালের খবর এসেছে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর, নদিয়ার চাকদহ, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর, শাসন, দত্তপুকুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং, ফলতা, পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল থেকে। ভাঙড়ের ২৬৫টি, ডায়মন্ড হারবারের ৩০টি, জয়নগরের ১১০, মথুরাপুরের ৩৫টি, ঘাটালের ১০১টি, কাঁথির ৪০টি, তমলুকের ১৩১টি, উত্তর কলকাতার ১৪০টি, বসিরহাটের ৫২টি, বনগাঁর ৩৯টি বুথ ছাড়াও দক্ষিণ কলকাতা, দমদম, ব্যারাকপুর, রানাঘাট ও নবদ্বীপ কেন্দ্রের বেশ কিছু বুথ এ দিন দখল হয়েছিল বলে অভিযোগ সিপিএমের।

খাস কলকাতা শহরে ভোটও এ দিন পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ছিল না। বিরোধী এজেন্টদের বুথে বসতে না-দেওয়া থেকে শুরু করে ছাপ্পা বা জাল ভোটের প্রচুর অভিযোগ। তিলজলায় বুথের বাইরে বোমাবাজিতে আতঙ্ক ছড়ায়। দু’দিন ধরে কাশীপুরে ও বেলেঘাটায় বিরোধীদের উপরে হামলা হচ্ছিল। তার রেশ ধরে এ দিন বেলেঘাটায় সিপিএম-সমর্থকদের মারধরের বহু অভিযোগ উঠেছে।

কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর তথা বিজেপি নেত্রী মীনাদেবী পুরোহিতের বাড়ির কাছে বোমা মারার খবর পেয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষক রাকেশ ঘটনাস্থলে যান। অভিযোগ, বন্দর এলাকাতেও শাসকদল গায়ের জোরে ভোট করিয়েছে। বাগবাজার, কসবায় ভোট শেষের মুখে উঠেছে সিপিএমের পার্টি অফিস ভাঙচুরের অভিযোগ।

রাতেও সিপিআইএম সমর্থকের বাড়িতে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সোমবার রাত ১১টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানার বামুনঘাটা এলাকায়। আক্রান্ত সিপিআইএম কর্মী মানসী ঘোষ পুলিশের কাছে জানান, তিনি যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে সিপিআইএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর সমর্থনে বামুনঘাটা বুথে এজেন্ট ছিলেন। যদিও অভিযোগ মানতে চায়নি তৃণমূল। ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়ক তথা ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য আরাবুল ইসলাম দাবি করেছেন, এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর জানা নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement