ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের নানা আপত্তিতে মাঝেমধ্যেই ভুগতে হচ্ছে পড়শি ওড়িশাকে। তাই আর পশ্চিমবঙ্গের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে বাজারে জোগান স্বাভাবিক রাখতে ওড়িশা সরকার সে রাজ্যে আলুর উৎপাদন বাড়াতে সক্রিয় হল। ওড়িশা সরকারের এই পদক্ষেপে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন এ রাজ্যের আলু চাষি এবং ব্যবসায়ীরা। কেননা, ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের নানা বিধিনিষেধের জেরে এমনিতেই তাঁরা ক্ষুব্ধ। এ বার ওড়িশা আলুর উৎপাদন বাড়ালে বাজার আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে বলে তাঁদের আশঙ্কা। কারণ, এ রাজ্যের উৎপাদিত আলুর অন্যতম বড় ক্রেতা পড়শি রাজ্যটি।
তবে, রাজ্য কৃষি দফতরের এক কর্তা মনে করছেন, এখানে আলুর যা বাজার রয়েছে, তাতে চাষি ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির আশঙ্কা এখনই নেই। পরিস্থিতির উপরে নজর রয়েছে বলে তিনি জানান। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর জন্য রাজ্যবাসী চড়া দামে আলু কিনবে আর সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে, তা হতে পারে না।
সে জন্যই সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।”
এ রাজ্যের বাজারে জোগান এবং দাম ঠিক রাখার যুক্তিতে সরকার চলতি মরসুমে বারে বারেই ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোতে লাগাম পরিয়েছে। মরসুমের গোড়ায় ওড়িশা-অসমের মতো ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ফলে, ওই সব রাজ্যের বাজারে আলুর সঙ্কট দেখা দেয়। আইনশৃঙ্খলার সমস্যার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ওড়িশায়। ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, রাজ্যের চাহিদার তুলনায় বেশি আলু রয়েছে হিমঘরগুলিতে। ভিন্ রাজ্যে আলু গেলে ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখতেন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে হিমঘরগুলিতে সঞ্চিত আলু পড়ে থেকে নষ্ট হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সে যুক্তি মানেনি সরকার।
ওড়িশা সরকারও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবকে আলুতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধও করেছিল। কিন্তু তাতেও রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত বদলায়নি। পরে অবশ্য ব্যবসায়ীদের ‘চাপে’ পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিষেধাজ্ঞা কিছুুটা শিথিল করে এই শর্তে, ১৩ টাকা কেজি দরে প্রতিদিন সরকারকে ২০০ টন আলু দেওয়া হলে ব্যবসায়ীরা ভিন্ রাজ্যে ১১০০ টন আলু পাঠাতে পারবেন। এর পরে হিমঘর-মালিকদের দাবিমতো সরকার আরও ৫০০ টন আলু ভিন্ রাজ্যে পাঠানোর ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু তাতেও ওড়িশা-অসমের মতো পড়শি রাজ্যে আলুর পুরো চাহিদা মিটছে না।
এই পরিস্থিতিতেই ওড়িশা সরকার বিকল্প রাস্তা হিসেবে নিজেদের রাজ্যে আলুর উৎপাদনের ভিত মজবুত করতে চাইছে। ওড়িশা কৃষি দফতরের অধিকর্তা আর কে গোপালন বলেন, “গত মরসুমে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব কিছু সমস্যার কারণে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী আলু পাইনি। তাই এ বর রাজ্যে অতিরিক্ত আলু চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গত মরসুমে আমাদের রাজ্যে ১৪০০ হেক্টর জমি থেকে ২ লক্ষ টন আলুর উৎপাদন হয়েছিল। এই মরসুমে আমরা আলুর চাষ দ্বিগুণ বাড়াতে চাই।”
ওড়িশা সরকারের একটি সূত্রের খবর, আবহাওয়া এবং মাটি একই রকম হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ ঘেঁষা ওড়িশার বালেশ্বর, ময়ূরভঞ্জ, ভদ্রকের মতো জেলাগুলিতে আলুচাষ বাড়ানো হচ্ছে। আলু চাষে উৎসাহ দিতে চাষি এবং ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে আলুবীজ কেনার ক্ষেত্রে চাষিদের ৫০ শতাংশ ভর্তুকি এবং সার ও চাষের অন্যান্য খরচের ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের হিমঘর তৈরিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। উন্নত আলুবীজের জন্য ইতিমধ্যেই তারা দ্বারস্থ হয়েছে পঞ্জাবের জালন্ধরের।
জালন্ধরের আলুবীজের অন্যতম বড় উৎপাদক সুখজিৎ সিংহ ভাট্টি এবং জঙ্গবাহাদুর সিংহ সাঙ্ঘা জানান, ওড়িশা থেকে ভাল আলুবীজের জন্য তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁরা প্রয়োজনীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন।
ওড়িশা আলুর উৎপাদন বাড়াচ্ছে, ব্যবসায়ীদের মারফত এ কথা জেনে এ রাজ্যের চাষিরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। তাঁদের বক্তব্য, চাষে সব সময়েই ঝুঁকি থাকে। চাষ ভাল হলে প্রতিবার যে ভাল দামই মিলবে তার নিশ্চয়তা নেই। আবার প্রকৃতি বিরূপ হলেও চাষ নষ্ট হয়। এই সব সামলে চাষি বা ব্যবসায়ীরা যখন নিজেদের উদ্যোগে প্রতিবেশী রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের আলুর ভাল বাজার তৈরি করেছেন, তখন সরকার কিছুটা যেচেই সে বাজার নষ্ট করছে।
পুড়শুড়ার আলুচাষি প্রশান্ত ধোলে বহুদিন ধরেই ওড়িশায় আলু পাঠাচ্ছেন। তিনি বলেন, “ওড়িশা আলু চাষ বাড়ালে নিশ্চিত ভাবেই আমরা মার খাব।” একই ভাবে বাঁকুড়ার সোনামুখীর চাষি শ্যামলকুমার দেয়াশী মনে করেন, “এ ভাবে বাজার নষ্ট হলে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।” আলু ব্যবসায়ীদের অন্যতম বড় সংগঠন ‘প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি’র রাজ্য সভাপতি আকাশদীপ সিংহ বলেন, “অসম এবং ওড়িশায় বেশি জমিতে আলু চাষ হলে তার নিশ্চিত প্রভাব পড়বে এখানে। আমরা সরকারি স্তরে আলোচনা করে সুরাহার রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করছি।”