আবেগ-যুদ্ধে জিতে তৃপ্ত ‘জেলা-পাগল এমএলএ’

পরনে সাদা পাজামা, ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। বয়স তখন সবে চল্লিশের কোঠায়, একদম মাঝখানে সিঁথি করে পেতে আঁচড়ানো চুল। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে পর্যন্ত ডিএম অফিস টু সিএম অফিস— তাঁকে দেখলে অফিসার-কর্মীদের অনেকেই প্রমাদ গুনতেন। মহাকরণ, বিধানসভার অলিন্দে যাঁকে দেখলেই ‘এই রে জেলা-পাগল এমএলএ’ এসেছে বলে ফিসফাসও শোনা যেত। কেউ আগেভাগেই সরে যেতেন।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০২:৫২
Share:

পরনে সাদা পাজামা, ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। বয়স তখন সবে চল্লিশের কোঠায়, একদম মাঝখানে সিঁথি করে পেতে আঁচড়ানো চুল। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে পর্যন্ত ডিএম অফিস টু সিএম অফিস— তাঁকে দেখলে অফিসার-কর্মীদের অনেকেই প্রমাদ গুনতেন। মহাকরণ, বিধানসভার অলিন্দে যাঁকে দেখলেই ‘এই রে জেলা-পাগল এমএলএ’ এসেছে বলে ফিসফাসও শোনা যেত। কেউ আগেভাগেই সরে যেতেন। কেউ দু-একটা কথার পরেই ব্যস্ততার অজুহাতে সরে পড়ার চেষ্টা করতেন।

Advertisement

তবুও নাছোড়বান্দা মনোভাব নিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ দশক ধরে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। অবশেষে শুক্রবার আলিপুরদুয়ার পৃথক জেলা হিসেবে সরকারি ভাবে ঘোষণা হতেই অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে গিয়েছেন সেই ‘জেলা-পাগল’ মানুষটি। তিনি হলেন আরএসপি নেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক নির্মল দাস।

এখন তাঁর বয়স ৭১ বছর। মাথায় আর চুল নেই। মুখের হাসিটি অবশ্য এতটুকুও পাল্টায়নি। দীর্ঘ যুদ্ধ জয়ের তৃপ্তি চোখে মুখে। তিনি বললেন, “এটা রাজনৈতিক লড়াই ছিল না। এটা ছিল আলিপুরদুয়ারের মানুষের আবেগ, মর্যাদার লড়াই। মানুষের সমবেত চেষ্টায় দাবি পূরণ হল। সকলকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।”

Advertisement

তবে তাঁর কথায়, এই কাজটা বাম আমলেই হতে পারত। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। তবে তাঁর আশা, জেলা আদায়ের জন্য যতটা সময় লেগেছে, সুষ্ঠু পরিষেবা দিতে তত টালবাহানা হবে না।

বস্তুত নির্মলবাবু যখন তিরিশের কোঠায় তখন থেকেই জেলা গঠনের স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। যদিও কংগ্রেস আমলেও জেলার দাবিতে অনেক সভা-সমাবেশ করেছেন অনেকেই। কিন্তু নির্মলবাবু গোটা বিষয়টিকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যান। জেলা নির্মাণ দাবি আদায় মঞ্চ গড়ে হইচই ফেলে দেন।

দিনরাত এক করে রাস্তায় নেমে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে লক্ষাধিক মানুষের সই সংগ্রহ করে রাজ্যপাল সহ প্রশাসনের নানা স্তরে পাঠিয়ে চাপ বাড়িয়ে দেন। আশির দশকের গোড়ায় বিধায়ক হয়ে বিধানসভায় গিয়েই আলিপুরদুয়ারকে আলাদা জেলার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে সরব হন।

নিয়মিত নানা স্তরে চিঠি পাঠানো, আমলারা ডুয়ার্সে গেলেই তাঁদের কাছে তদ্বির করাটা রুটিন হয়ে গিয়েছিল নির্মলবাবুর। অবস্থাটা এমন হয়েছিল, জলদাপাড়া বেড়াতে গেলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও নির্মলবাবুকে দেখলে ইশারায় বুঝিয়ে দিতেন, ব্যাপারটা তাঁর মাথায় রয়েছে। আরএসপি সূত্রের খবর, পরের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও মহাকরণে বা বিধানসভায় নির্মলবাবুর সঙ্গে দেখা হলেই ‘কাজ এগোচ্ছে’ বলে জানিয়ে দিতেন। নানা অনুষ্ঠানে রাজ্যপালরা ডুয়ার্সে গেলেই স্মারকলিপি পেতেন নির্মলবাবুর কাছ থেকে।

এ ভাবে নানা স্তরে চাপ বাড়ানোয় একটা সময়ে প্রাক্তন মুখ্য সচিব অমিতকিরণ দেবের নেতৃত্বে জেলার দাবি খতিয়ে দেখতে কমিটি হয়।

সেই কমিটি রিপোর্টও দেয়। নির্মলবাবুর আক্ষেপ, ওই কমিটি জেলা গঠনের সুপারিশ করে। পরের মুখ্য সচিব জেলা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেও জানান। কিন্তু নানা প্রশাসনিক জটিলতায় কাজ থমকে যায়।

তাঁর কথায়, “সেই থেকে ঠিকঠাক ঘুমোতে পারিনি।”

রাজ্যে নিজেরা ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে যা করাতে পারেননি, তৃণমূল জমানায় তা হল। তাতে অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে বিঁধছে সেটা স্বীকার করলেও মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের আমলে হয়নি। কেন হয়নি সেটা অনেকেই জানেন। আমিও জানি। এখন হয়েছে। এটাই বাস্তব। বাস্তবটা সকলকেই মেনে নিতে হয়।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement