শ্যামল মাইতি
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত ও শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের ধরপাকড় নিয়ে রাজ্য রাজনীতি এখন সরগরম। এরই মধ্যে শুক্রবার রাতে সারদার এক এজেন্টের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হল পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটে। মৃত শ্যামল মাইতির (৩৮) স্ত্রী অনুরাধাদেবী স্বামীর এই পরিণামের জন্য তৃণমূল নেতৃত্বকেই দুষছেন।
শুক্রবার রাতেই মুর্শিদাবাদের সুতিতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে আর এক লগ্নি সংস্থা রোজ ভ্যালির মহিলা এজেন্ট দশমী দাস (৩২)-এর দেহ। তিনি সাকসেস ভ্যালি নামে আরও একটি লগ্নি সংস্থার এজেন্ট হিসেবেও কাজ করতেন। পুলিশের ধারণা, কোলাঘাটের শ্যামলবাবুর মতোই দশমীদেবীও টাকা ফেরতের জন্য আমানতকারীদের চাপে আত্মঘাতী হয়েছেন।
সারদার এজেন্ট শ্যামলবাবুর স্ত্রী অনুরাধাদেবী সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুলছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্য, “আমার স্বামী তো মদন মিত্রদের দেখেই সারদায় এজেন্টের কাজ নিয়েছিল। মদন মিত্র বিভিন্ন মিটিংয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা যেখানে আছি, সেখানে নিশ্চিন্তে টাকা জমা দাও’। যাঁরা এত পরিবারকে কাঁদিয়েছেন, তাঁদের শাস্তি হওয়া দরকার।” অনুরাধাদেবীর সংযোজন, “তৃণমূলে শুনেছি নেত্রীর অগোচরে কিছুই হয় না। তাহলে মদনবাবুদের এত বড় দুর্নীতি নেত্রী জানেন না, বিশ্বাস করতে হবে!”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কোলাঘাটের হীরাপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্যামলবাবুদের পরিবার বেশ সম্পন্ন। শ্যামলবাবুর বাবা সুষেন মাইতি রেলে চাকরি করতেন। গত জুলাইয়ে অবসরের পর তিনি আবার হলদিয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। শ্যামলবাবু প্রথমে স্থানীয় রামতারক বাজারে কাপড়ের দোকান চালাতেন। ২০০৯ সালে সারদার এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তারপর ওই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। পরিবার সূত্রে খবর, বেশ বড় মাপের এজেন্ট ছিলেন ওই যুবক। সব মিলিয়ে ৭৫ লক্ষ টাকা সারদা লগ্নি সংস্থায় জমা করেছিলেন বলে এ দিন দাবি করেন শ্যামলবাবুর বাবা সুষেনবাবু। তিনি বলেন, “২০১৩ সালের মার্চে সারদা কেলেঙ্কারির পরে আমানতকারীরা টাকার জন্য ছেলের ওপর চাপ দিতে শুরু করে। বৌমার গয়না বেচে, আমার থেকে টাকা নিয়ে ছেলে বেশ কিছু টাকা ফিরিয়েও দিয়েছিল।”
তাহলে নতুন করে কী হল যে, আত্মহত্যা করতে হল শ্যামলবাবুকে?
মৃতের স্ত্রী অনুরাধাদেবী বলেন, “সকলকে তো আর টাকা ফেরত দেওয়া যায়নি। তাই চাপ ছিলই। তার উপর শ্বশুরমশাই অবসর নেওয়ার পরে বাড়িতে রঙের কাজ হয়। এ সব দেখে লোকজনের ক্ষোভ আরও বেড়েছিল।” অনুরাধাদেবী আরও জানান, গত বুধবার টাকা চেয়ে ভরা বাজারে কিছু লোক শ্যামলবাবুকে হেনস্থা করে। তাঁর মোটরবাইকও কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর থেকেই শ্যামলবাবু মনমরা ছিলেন।
ঠিক কী ঘটেছিল শুক্রবার রাতে?
অনুরাধাদেবী বলেন, “রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে আমি ছেলেকে নিয়ে একতলায় ছিলাম। ও (শ্যামল) দো’তলার ঘরে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ সাড়া না পাওয়ায় আমি গিয়ে দেখি, ওর দেহ ঝুলছে।”
সুতির ফতুল্লাপুর গ্রামের দশমীদেবীও আমানতকারীদের চাপের মুখে পড়ে অবসাদে ভুগছিলেন বলে জানিয়েছেন তাঁর স্বামী পেশায় দিনমজুর মনোরঞ্জন দাস। তাঁর কথায়, “দু’টি সংস্থার হয়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা তুলেছিল আমার স্ত্রী। কিন্তু ওই দুই সংস্থার অফিসে ঘুরে ঘুরেও আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি। লোকে নানা কথা বলত। ক’দিন ধরে তাই বাড়ি থেকেও বেরোত না দশমী।” শুক্রবার রাতে মাঠ থেকে ফিরে মনোরঞ্জনবাবু দেখেন, টালির ঘরের কড়িকাঠ থেকে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ঝুলছে দশমীর দেহ। স্থানীয় সাদিকপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভারপ্রাপ্ত প্রধান আরএসপি-র দিলীপ সরকার বলেন, “ওই মহিলার বাড়িতে বেশ কয়েকবার আমানতকারীরা চড়াও হয়েছিল। এতে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তার জেরেই শেষমেশ আত্মহত্যা করেছেন বলে আমাদের অনুমান।” এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রোজ ভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুর মোবাইলে এ দিন একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কথা বলা যায়নি।