অনেক হয়েছে, আর না!
বিধানসভা ভোটের আগে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করতে এই ছিল তৃণমূল নেত্রীর স্লোগান। রাজ্যের মসনদে সাড়ে তিন বছরের মাথায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিত্যদিনের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে সেই পুরনো স্লোগানকেই আঁকড়ে ধরলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী। যাদবপুরের সমাবর্তনে ছাত্রীর শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তুলে সাধন পাণ্ডের মন্তব্যে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল। তাঁর দুই সতীর্থ মন্ত্রীর সেই মন্তব্যের পরে রবিবার পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর্জি জানিয়েছেন, বিতর্ক এ বার বন্ধ হোক। সেই সঙ্গে এ-ও বলেছেন, উপাচার্যের ‘অনড়’ থাকলে চলবে না।
সুরটা অবশ্য বেঁধে দিয়েছিলেন আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। যাদবপুরের সমাবর্তন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে রবিবার তিনি বলেন, “এই নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক তৈরি করা উচিত নয়। গণতান্ত্রিক দেশে সকলের মত প্রকাশের অধিকার আছে। জানি, ওই ছাত্রী ক্ষমা চেয়েছে সংবাদপত্রে। আমি চাই, বিতর্ক বন্ধ হোক।” সুব্রতবাবু যখন যাদবপুরের ওই ছাত্রী গীতশ্রী সরকারের প্রতিবাদের পন্থাকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন, তখন পাল্টা বিবৃতি দিতে গিয়ে ‘রাজ্যপালের অসম্মান’কেই ঢাল করেছিলেন আর এক মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। বকলমে সেটাই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য।
কিন্তু শনিবার রাজ্যপাল জানান, বিনম্র ভাবে পদক নিতে অস্বীকার করেছিলেন গীতশ্রী। ‘রাজ্যপালের অসম্মানে’র তত্ত্ব ধোপে না টেকায় আরও বিড়ম্বনায় পড়ে শাসক দল। তার পর এ দিনও রাজ্যপাল বলেছেন, “ওই ছাত্রী খুব নম্র এবং ভদ্র ভাবে পদক নিতে অস্বীকার করে। আমি তাকে বলি, চলে যাও। তার পরে সেখানে কোনও স্লোগান হয়নি, কালো পতাকা দেখানো হয়নি।” তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, শুক্রবার ও শনিবার দুই মন্ত্রী যখন দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে মুখ খুলেছিলেন, পার্থবাবু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু এ দিন রাজ্যপাল বিতর্ক বন্ধ করার আহ্বান জানানোর পরেই তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করেন শিক্ষামন্ত্রী।
পার্থবাবুর এ দিন বলেছেন, “ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকদের নমনীয় হতে হবে। উপাচার্যেরও অনড় থাকলে চলবে না!” উপাচার্যের প্রতি অনড় না-থাকার যে বার্তা এ দিন শিক্ষামন্ত্রীর গলায় শোনা গিয়েছে, দল ও সরকারের অন্দরে সাম্প্রতিক বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তা-ও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। যাদবপুরের অচলাবস্থা কাটাতে আন্দোলনরত পড়ুয়া, শিক্ষক এবং উপাচার্য তিন পক্ষের সঙ্গেই তিনি ফের আলোচনায় বসবেন বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন।
তবে দলেরই নেতা-মন্ত্রীরা যে ভাবে পরিস্থিতি ঘোরালো করে তুলেছেন, তাতে মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এ দিন কালীঘাটের বাড়িতে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাপ্তাহিক বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘সিনিয়র’ বলেই নেতা-মন্ত্রীরা যেন যেমন খুশি চলার কথা না ভাবেন! প্রত্যেকের জন্যই দল ও সরকারে ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’ আছে! যাদবপুরে কেন জলঘোলা হয়েই চলেছে, রুষ্ট স্বরে তার সমাধান খোঁজার ভার শিক্ষামন্ত্রীকে দিয়ে এ দিন তড়িঘড়ি মেদিনীপুর রওনা হয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। সুব্রতবাবু, সাধনবাবুরা অবশ্য ওই ঘরোয়া বৈঠকে ছিলেন না। তবে পরে বালিগঞ্জে এক অনুষ্ঠানের অবসরে এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সুব্রতবাবু ফের বলেছেন, “একটা বাচ্চা মেয়ে কী ভাবে অহিংস প্রতিবাদ করে দেখিয়ে দিয়েছে, আমি সেই কথাই বলেছি।” কিন্তু দল তো সেই কথা সমর্থন করছে না! সুব্রতবাবুর বক্তব্য, “ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি নিয়ে নানা মত থাকতে পারে। আমি মেয়েটির প্রতিবাদের ভঙ্গিমা নিয়ে কথা বলেছি। সেটা নিয়ে তো কোনও আপত্তি আছে বলে মনে হয় না!” যদিও সুব্রতবাবু দু’দিন আগে মুখ খোলার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ফিরহাদ যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে আপত্তি তোলা হয়েছিল প্রতিবাদের ধরন নিয়েই!
সুব্রতবাবুর মতোই গীতশ্রীর প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যাদবপুরের তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু। সারদায় টাকা নয়ছয়ে অভিযুক্তদের শাস্তি চেয়ে ক’দিন আগে নেত্রীকে বিপাকে ফেলেছিলেন যিনি। নজরুল মঞ্চে নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানের পরে এ দিনও এই অধ্যাপক বলেছেন, “বিশৃঙ্খলা না করে যদি প্রতিবাদ করা যায়, তবে তা সমর্থনযোগ্য। তবে আচার্যকে সব সময় শ্রদ্ধা ও সম্মান করা উচিত।” যাদবপুরের জন্য কর্তৃপক্ষ একটি ‘নির্ভরযোগ্য সমাধানসূত্র’ তৈরি করবেন বলেও আশা প্রকাশ করেছেন সুগতবাবু।
তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, যাদবপুর নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক চলতে থাকলে তাঁদেরই বিড়ম্বনা বাড়বে। তাই রাজ্যপালের সুরেই বিতর্কে ইতি টানার কথা বলছেন তাঁরা। রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজাও এ দিন বলেছেন, “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যা চলছে, তা বন্ধ হওয়া উচিত। তবে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীই যা করার করবেন।” চাপ অব্যাহত বিরোধীদেরও। সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনায় বসা উচিত বলে দাবি করে কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “বিবেক বলে কিছু থাকলে উপাচার্যের পদ আঁকড়ে থাকা উচিত নয়! আশা করব, সুব্রতবাবু, সাধনবাবুদের মতো প্রবীণ নেতাদের বিবেক আগামী দিনে আরও কড়া হবে!”
দু’দিন ধরে চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করার পরে উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী কিন্তু রবিবার নীরব! দিনভর তাঁর মোবাইল বন্ধ ছিল। রাতে ফোন বাজলেও তিনি ধরেননি। তবে আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা এবং শিক্ষক সংগঠন জুটা জানিয়ে দিয়েছে, উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া তাদের আর কোনও শর্তই নেই। সুতরাং, নতুন করে শিক্ষামন্ত্রী আলোচনায় ডাকলেও সমাধানসূত্র কিছু বেরোবে কি না, সেই সংশয় থাকছেই।