অস্ত্র আইনেও মামলা, আজ পুলিশের কাছে যাচ্ছেন বাবুল

গোটা দেশ জানে, গানই তাঁর অস্ত্র। লোকসভা ভোটে দাঁড়ানো বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে ‘গান’-এর জন্যই অস্ত্র আইনে মামলা রুজু হয়েছে! আজ, বৃহস্পতিবার বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠাচ্ছে পুলিশ।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩১
Share:

গোটা দেশ জানে, গানই তাঁর অস্ত্র। লোকসভা ভোটে দাঁড়ানো বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে ‘গান’-এর জন্যই অস্ত্র আইনে মামলা রুজু হয়েছে! আজ, বৃহস্পতিবার বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠাচ্ছে পুলিশ।

Advertisement

তৃণমূলের সঙ্গে বচসার জেরে শাসক দলের তরফে আসানসোল কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী বাবুল এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল ১২ এপ্রিল। অস্ত্র আইনে মামলা রুজু হয়েছিল সেই দিনই। কিন্তু ওই ঘটনা নিয়ে রানিগঞ্জের বিডিও রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের কাছে যে ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়েছেন, তাতে অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি বলেই কমিশন সূত্রের খবর। সুতরাং গোটা ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছায়া রয়েছে বলেই দাবি করছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন বলেন, “আসানসোল কেন্দ্রে বিজেপি-র সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না বলেই তৃণমূল বাবুল সুপ্রিয়কে বারবার প্রচারে বাধা দিচ্ছে! বর্ধমানের জেলাশাসক ও রানিগঞ্জ থানার ওসি শাসক দলের হয়ে কাজ করছেন বলে ওঁদের পদ থেকে অপসারণের দাবি জানিয়েছি কমিশনের কাছে।”

গত ১২ তারিখ সকালে রানিগঞ্জে তাঁর প্রচারে এক দল তৃণমূল সমর্থক হামলা চালায় বলে প্রথমে অভিযোগ করেছিলেন বাবুলই। রানিগঞ্জের তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সেনাপতি মণ্ডল-সহ আরও চার জনের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। এর পরেই পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেন সেনাপতিবাবু। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩, ৩২৫ এবং অস্ত্র আইনের ২৫ ও ২৭ ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ।

Advertisement

ক্লিক করুন.....

সেনাপতিবাবু এ দিন বলেন, “বাবুল সুপ্রিয়ের কাছে অস্ত্র ছিল, এ কথা আমরা অভিযোগে বলিনি। পুলিশকে জানিয়েছি, তাঁর সঙ্গে সে দিন এমন কয়েক জন ছিল, যাদের কাছে অস্ত্র ছিল।” এই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই পুলিশ বাবুলকে এ দিন চিঠি পাঠায়। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসিপি (সেন্ট্রাল) বিশ্বজিত্‌ ঘোষ বলেন, “পুলিশের কাছে নির্দিষ্ট ভাবে লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তাই বাবুল সুপ্রিয়কে ডেকে পাঠানো হয়েছে।” রানিগঞ্জের সার্কেল ইনস্পেক্টর বামাপদ দাসের কাছে আজ যেতে হবে বাবুলকে। বাবুল বুধবার বলেন, “ফৌজদারি আইন সম্পর্কে কোনও ধারণাই আমার নেই। তবে জানতে পেরেছি, অস্ত্র আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। কাল পুলিশের কাছে আমি একাই যাব। যাঁরা এ সব করছেন, তাঁরা ৭ মে ভোটটা হতে দিন!”

আসানসোলে ভোট হবে ওই দিনই। বুধবারই বাবুল তার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

আসানসোলে প্রার্থী হয়ে বাবুল প্রচার শুরু করার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ এসেছে। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে মত্ত অবস্থায় প্রচার ও মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ আনা হলেও তা খারিজ করে দেয় নির্বাচন কমিশন। এ বার তাঁর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লোকজন নিয়ে প্রচারে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। সেই সঙ্গে বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে জাতীয় সড়ক-৬০ আটকে রাখা এবং ওসি-র মোবাইল কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছে রানিগঞ্জ থানার পুলিশ। তার ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৬, ১৪৩, ২৮৩ ধারা এবং ১৯৫৬ সালের জাতীয় সড়ক আইনের ৮ (বি) (২) ধারায়ও মামলা রুজু হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, সে দিনের ঘটনা নিয়ে রানিগঞ্জের বিডিও একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন আসানসোল কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসার অমিত দত্তের কাছে। বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন মারফত সেই রিপোর্ট এসে পৌঁছেছে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতরেও। রিপোর্টে দু’পক্ষের বচসার জেরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক দুপুর ২টো ১০ থেকে ২টো ৪০ মিনিট পর্যন্ত অবরুদ্ধ ছিল বলে জানানো হয়েছে। ওই দিন গোলমালের খবর পেয়ে বিজেপি প্রার্থী রানিগঞ্জে পৌঁছনোর পর থেকে সমস্ত ঘটনার ছবিও তুলে রেখেছেন কমিশনের নিজস্ব ভিডিওগ্রাফার বা এমসিসি টিম। খবর পেয়ে বিডিও নিজেও সেখানে পৌঁছন। ঘটনাস্থলে ছিলেন স্থানীয় থানার ওসি-ও। বিডিও তাঁর রিপোর্টের সঙ্গে কমিশনে ওই ভিডিও সিডিটি জমা দিয়েছেন।

সিডিতে দেখা যাচ্ছে, বাবুল ঘটনাস্থলে যাওয়ার পরে উত্তেজনা তৈরি হয়। তৃণমূল নেতারা বাবুলকে ঘিরে ধরেন। ধাক্কাধাক্কিও হয়। পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামলানোর পরে বিজেপি প্রার্থী গাড়িতে গিয়ে বসেন এবং থানার উদ্দেশে রওনা দেন। থানায় গিয়ে অভিযোগ করার ছবিও কমিশন তুলে রেখেছে।

কিন্তু বচসার সময় বিজেপি প্রার্থী কোনও পুলিশ অফিসারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিচ্ছেন এমন ছবি মেলেনি ভিডিও ফুটেজে। এমনকী, প্রার্থী বা সমর্থকদের হাতে অস্ত্র থাকার কোনও ছবিও না। স্বভাবতই, বিডিও-র যে রিপোর্ট কমিশনকে পাঠিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার, তাতে অস্ত্রশস্ত্র বা সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার উল্লেখ নেই। শুধু ঘটনার জেরে ৩০ মিনিটের জন্য জাতীয় সড়ক বন্ধ থাকার কথা লেখা আছে। জেলাশাসক বলেন, “বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে দু’টি রিপোর্ট পেয়েছি। কমিশনের কাছে তা পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন, তাই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করছি না।”

কমিশনের ভিডিওতে ধরা না-পড়লেও আসানসোলের পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের পাঠানো রিপোর্টে কিন্তু পুলিশ অফিসারের মোবাইল কেড়ে নেওয়া ও জাতীয় সড়ক অবরোধ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার বিনীত বলেন, “আমরা যে রকম লিখিত অভিযোগ পেয়েছি, সেই মতো মামলা রুজু করে তদন্ত করছি।” কিন্তু বাবুল অস্ত্র রাখার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। বিনীতের বক্তব্য, “নির্দিষ্ট ভাবে বাবুল সুপ্রিয়ের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, এমন অভিযোগ না-ও থাকতে পারে। তার মানে এই নয় যে, বাবুল সুপ্রিয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রুজু করা যাবে না। অভিযোগে ঠিক কী রয়েছে, সেটা বলা যাবে না।”

পুলিশের অন্য একটি সূত্রের খবর, অভিযোগে বলা হয়েছে বাবুলের সঙ্গে এক দল লোক ছিল এবং তাদের মধ্যে কারও কারও কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। ওই হাঙ্গামাকারীরাই গোলমাল পাকিয়েছিল এবং বাবুল তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে দাবি। সে ক্ষেত্রে কি খোদ বাবুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রুজু করা যায়? পুলিশের দাবি, তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় বাবুলের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, তখন চার্জশিটে তাঁকে অস্ত্র আইনে অভিযুক্ত করা হবে না। কিন্তু মামলা রুজু করার সময়ে অস্ত্র আইনের ধারা দিতে আইনি বাধা নেই। যদিও আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এক অফিসারের বক্তব্য, কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র না-পেলে তাঁকে অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করা যায় না। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও রুজু হয় না।

বিজেপি-র তরফে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যেখানে কমিশনের ভিডিওগ্রাফিতে কাউকে অস্ত্র নিয়ে দেখাই যায়নি, সেখানে পুলিশ কমিশনার কীসের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট পাঠালেন? যদি পুরো ঘটনাটা ৩০ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, তা হলে বাবুল এক ঘণ্টা মোবাইল ফোনই বা কেড়ে রাখলেন কী ভাবে? ভুয়ো মামলায় বাবুলকে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিজেপি। রানিগঞ্জ থানা থেকে বাবুলকে এ দিনই ওই জামিন অযোগ্য মামলার ব্যাপারে দেখা করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য বিজেপি প্রশাসনের কাছে আরও ৪৮ ঘণ্টা সময় চেয়ে নিয়েছে।

বাবুল জানিয়েছেন, পুলিশের দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই তিনি বামাপদবাবুর সঙ্গে কাছে যাবেন। তাঁর দাবি, তিনি নির্দোষ। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল পুলিশকে বোমা মারতে বলা-সহ আরও নানা মন্তব্য করেছেন। তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদধন্য হয়ে তাঁর সঙ্গেই ঘুরছেন অনুব্রতবাবু! আর মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা আমাকে হয়রান করা হচ্ছে!” পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে সে দিন ‘গোলমাল থামানো’র পরে এমন পরিণতি তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল না বলে তাঁর দাবি। নির্বাচনী ময়দানে এসে এমন ‘নোংরামি’র মধ্যে পড়তে হবে, এমন ধারণা তাঁর ছিল না বলেও ঘনিষ্ঠ মহলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

রানিগঞ্জের সিআই বামাপদবাবুকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ সব অভিযোগই নিতে ও তদন্ত করতে বাধ্য। বিজেপি প্রার্থীর দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে তৃণমূল নেতা সেনাপতি মণ্ডলদেরও ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা আদালত থেকে জামিনও নিয়েছেন।”

কিন্তু বিজেপিৃর মতোই অন্য বিরোধী দলগুলিও শাসক দল এবং পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী যেমন বলেছেন, “বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলের বিপদের কারণ হয়েছেন বলেই তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রুজু করেছে।” তাঁর দাবি, “বাবুল আর আমার হাল একই

রকম! আমি কোচবিহারে ভোটের প্রচার করছি আর মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশ সীমান্তে দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষে খুনের ঘটনায় আমার নামে এফআইআর হচ্ছে।” একই সুরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে আমার এবং সাত্তার মোল্লার বিরুদ্ধে খুনের মামলা আনা হয়েছিল! ওঁরা অনুব্রত মণ্ডলদের সম্পদ মনে করেন আর অন্য দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যেমন পারেন, অভিযোগ আনেন!”

শাসক দল কী বলছে? ঘটনা সম্পর্কে বিশদে না-জেনে মন্তব্য করতে চান না বলে জানিয়েই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “আইন আইনের পথে চলবে। বাবুল সুপ্রিয় বলে আলাদা কিছু হবে না। রাজনৈতিক পতাকার রং দেখে বিচার হবে না।” বিরোধীরা যে অন্য কথা বলছেন? পার্থবাবুর দাবি, “কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম এটা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement