তৃণমূল আর বিজেপির কাছে জমি খুইয়ে মেরুকরণের রাজনীতিতে নাম লেখাল সিপিএম-ও!
সেই লক্ষ্যে এক দিকে বর্ধমান-কাণ্ডে এনআইএ তদন্তের পক্ষে জোর সওয়াল করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। অন্য দিকে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্বের দাবিতে সরব হয়েছেন দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব।
বর্ধমানের ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আন্তর্জাতিক জঙ্গি যোগ উদ্ঘাটন করতে কারাট এনআইএ তদন্তের পক্ষে মুখ খোলায় অনেকেই অবাক। কারণ ইতিহাস বলছে, এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিতে বিশেষ দেখা যায়নি। বরং প্রাক্ স্বাধীনতা আমলে ১৯৪২-এর আন্দোলনের সময়, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময় বা তার পরে ১৯৬২-র চিন যুদ্ধের সময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে বারে বারেই জাতীয়তাবিরোধী অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পৃথক দল হিসাবে সিপিএম জন্ম নেওয়ার পর ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ না উঠলেও জাতীয়তাবাদের পক্ষে জোরালো ভাবে সওয়ালও করেনি তারা।
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে এখন হঠাৎ কেন জাতীয়তাবাদী হলেন কারাট? বর্ধমানের ঘটনায় সন্ত্রাসবাদী-মৌলবাদী চক্রের যোগসাজশ যত খোলসা হচ্ছে এবং তৃণমূল যত সংখ্যালঘু-বান্ধব অবস্থান নিচ্ছে, ততই তার বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া সংখ্যাগুরু ভাবাবেগের ফায়দা নিতেই কারাট এই অবস্থান নিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ, সোজা কথায়, সাম্প্রতিক কালে এ রাজ্যের লোকসভা এবং বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপির কাছে ভোটব্যাঙ্ক খুইয়ে কারাটেরা আর গেরুয়া শিবিরকে ময়দান ছেড়ে দিতে নারাজ!
কিন্তু শুধু হিন্দু ভোট কব্জা করে দলের বেহাল দশা যে ফেরানো যাবে না, সেটা সিবিএম বিলক্ষণ জানে। বস্তুত, তৃণমূল সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক কেড়ে নেওয়ার ফলেই রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে তাদের। সুতরাং সংখ্যালঘুদেরও ফের কাছে টানার চেষ্টার, ভারসাম্যের রাজনীতিতে গৌতম দেব বাংলাদেশি শরণার্থীদের নিয়ে সরব হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও গৌতমবাবুর নিজের ব্যাখ্যা, বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন যখন আসন্ন, তখন সেখানকার মতুয়া সম্প্রদায়ের দাবির কথা মাথায় রেখেই শরণার্থীদের নাগরিকত্বের দাবি তুলেছেন তিনি। যদিও দলের অন্দরেই অনেকে এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ।
বিজেপি অবশ্য গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা গ্রহণ করেই সিপিএমের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। তাঁর বিবৃতির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ দাবি করেছেন, উদ্বাস্তু এবং মতুয়াদের দাবি পূরণের উপযুক্ত দল তারাই। তাঁর বক্তব্য, “মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলন করে সিপিএম ভোট কুড়িয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার ৩৪ বছরে মতুয়াদের কথা তাদের মনে পড়েনি। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুরা জ্যোতি বসুর পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। সুতরাং, উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলনের কথা তাদের মুখে মানায় না।”
মেরুকরণের রাজনীতির পরিসর দখলের চেষ্টা পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। শনিবার প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তার পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “অনুপ্রবেশের নাম করে বিজেপি সংখ্যালঘুদের চিহ্নিত করতে চাইছে। এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি আমরা মানব না। কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বাস্তু নীতি পুনর্বিবেচনা করুক।”
কংগ্রেসের শক্তি এখন মূলত যে হেতু মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং উত্তর দিনাজপুরের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায়, তাই অধীরের দলের এই অবস্থান স্বাভাবিক। অধীরের ব্যাখ্যা, আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অনুপ্রবেশ সমস্যার সমাধান করা দরকার। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে ঠিকমতো বেড়া দেওয়ার দাবিও তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি।