রায় ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের

চিকিৎসা বিভ্রাটে বধূকে আড়াই লক্ষ ক্ষতিপূরণ

লাইগেশন করানোর এক বছরের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন তরুণী গৃহবধূ। বন্ধ্যাকরণের অস্ত্রোপচার যিনি করেছিলেন, সেই চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি কিছু ওষুধ দেন। কোনও পরীক্ষা ছাড়াই।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:৩৩
Share:

লাইগেশন করানোর এক বছরের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন তরুণী গৃহবধূ। বন্ধ্যাকরণের অস্ত্রোপচার যিনি করেছিলেন, সেই চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি কিছু ওষুধ দেন। কোনও পরীক্ষা ছাড়াই। তাতে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়। শেষমেশ অন্য এক চিকিৎসক কঠিন অস্ত্রোপচার করে বার করেন দেড় কেজি ওজনের ভ্রূণ। ৩২ বছরের তরুণী, হাওড়ার মামণি রায় এখন ঠিকঠাক হাঁটাচলা করতে পারেন না। ভারী জিনিসপত্র তোলাও তাঁর বারণ।

Advertisement

সাড়ে চার বছর আগের ওই ঘটনায় চিকিৎসার গাফিলতির দায়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সুমন সরকারকে সম্প্রতি আড়াই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালত। তা ছাড়া, গোটা মামলা চালাতে ওই গৃহবধূর যা খরচ হয়েছে, সেই বাবদ ওই চিকিৎসককে আরও ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে।

উদয়নারায়ণপুরের বাসিন্দা মামণি রায় দুই সন্তানের মা। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ তিনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন আমতার এক নার্সিংহোমে। অভিযুক্ত চিকিৎসক সুমন সরকারের হাতেই ওই শিশুর জন্ম। সে দিনই ওই মহিলা লাইগেশন করিয়ে নেন।

Advertisement

কিন্তু মামণিদেবী জানাচ্ছেন, লাইগেশনের এক বছরের মধ্যেই তিনি সুমনবাবুকে দেখাতে যান। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি ফের গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন।

ওই মহিলার কথায়, ‘‘ডাক্তারবাবু কেবল কয়েকটি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। কোনও পরীক্ষা করাতে বলেননি। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার পর তলপেটে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়, বার বার জ্ঞান হারাতে থাকি। পরের দিন ফের ওই চিকিৎসককে সে কথা জানানো হলে তিনি একই ওষুধ খেয়ে যেতে বলেন।’’ তাতে অবশ্য কোনও কাজ হয়নি। উল্টে ওই মহিলার শারীরিক অবস্থার এত অবনতি হয় যে, তাঁকে হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান বাড়ির লোকজন।

সেখানে হওয়া পরীক্ষায় ধরা পড়ে, মামণিদেবী অন্তঃসত্ত্বা। তবে চিকিৎসা পরিভাষায় তাঁর ‘একটোপিক প্রেগন্যান্সি’ হয়েছে। অর্থাৎ ভ্রূণ জরায়ুতে গঠিত না হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। ভিতরে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল ওই মহিলার। মামণির স্বামী প্রিয়ঙ্কর রায়ের কথায়, ‘‘ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেটে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। ২০১২-র ১৪ মার্চ অস্ত্রোপচার করে আমার স্ত্রীর দেহ থেকে প্রায় দেড় কেজি ওজনের ভ্রূণ বার করা হয়। আমার স্ত্রী এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। ঠিক মতো হাঁটার ক্ষমতাও নেই।’’

কী বলছেন অন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা? চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘লাইগেশন করানোর পরেও একটোপিক প্রেগন্যান্সি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে কথা মাথায় রেখে চিকিৎসকের উচিত ছিল, রোগী যখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লক্ষণ নিয়ে তাঁর কাছে গেলেন, ভাল ভাবে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। সেটা না করা চিকিৎসকের

বিচারের ভুল।’’

আর এক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কোনও চিকিৎসক হয়তো দু’শো লাইগেশন ঠিকঠাক করেছেন, কিন্তু তার পরেও দেখা গেল, কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। এমনটা হতেই পারে। তবে সেটা মাথায় রেখে সতর্ক থাকতে হয় চিকিৎসককে।’’ মল্লিনাথবাবু মনে করেন, ‘‘হাওড়ার ঘটনাটির ক্ষেত্রে রোগীর একটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা জরুরি ছিল। এটা অবশ্যই চিকিৎসকের গাফিলতি।’’

তবে অভিযুক্ত চিকিৎসক সুমন সরকার অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘রোগী সঠিক কথা বলছেন না। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লক্ষণ নিয়ে প্রথম বার আমার কাছে আসার পর ইউএসজি করাতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আর আমার কাছে ফিরে আসেননি।’’ সুমনবাবু বলেন, ‘‘রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করব আমি।’’

২০১৩ সালের জুলাই মাসে প্রথমে হাওড়া জেলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালত অবশ্য রায় দিয়েছিল, এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার কোনও গাফিলতি নেই। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করেছিলেন মামণি রায়। গত মাসে আদালত তার রায়ে জানিয়ে দেয়, মামণিদেবীর চিকিৎসায় গাফিলতি হয়েছিল। অভিযুক্ত চিকিৎসককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আড়াই লক্ষ টাকা দিতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement