পুলিশ ক্যাম্পের ভিতরে এ ভাবেই থাকেন পুলিশ কর্মীরা।—নিজস্ব চিত্র।
এ যেন প্রদীপের নীচে অন্ধকার!
এক পাশে প্রায় ৭২ কোটি টাকা খরচে তৈরি সরকারি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত একাধিক সুদৃশ্য ভবন। বাংলো, সরকারি দফতর, অতিথি নিবাস। বিরাট সুইমিং পুল, ফুল-ফলের বাগানও। প্রায় শত কোটির ওই সম্পদ যে ২২ জন পুলিশ অফিসার-কর্মী দিনরাত আগলে রাখেন, তাঁদের থাকার কোনও সুষ্ঠু জায়গা নেই। দরমার বেড়ার শৌচালয়, ভাঙা টিন এবং লোহার পাইপ দিয়ে তৈরি ঘুপচি অন্ধকার ঘর বরাদ্দ তাঁদের জন্য। কাদা জলে প্রায় খোলা আকাশের নিচেই একচিলতে রান্নাঘর। অনেকটাই যেন কোনও অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরের মতই। অস্থায়ী বিদ্যুতের সংযোগ। বৃষ্টি বাড়লেই যেমন ঘরে জল ঢোকে। সাপ-পোকামাকড়ও ঢুকে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গের শাখা সচিবালয় ‘উত্তরকন্যা’য় গেলেই ওই দৃশ্য চোখে পড়বে।
উদ্বোধনের পর থেকেই রাতদিন শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে দুই জন অফিসার-সহ ২০ জন পুলিশ কর্মী উত্তরকন্যায় মোতায়েন আছেন। কখনও নির্মিয়মান ভবনের কোণে, আবার কখনও ত্রিপল টাঙিয়ে আবার এখন ভাঙা টিন জোড়া দিয়ে ক্যাম্প তৈরি করে দিন কাটাচ্ছেন ওই পুলিশ কর্মীরা। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ মহলের একাংশে ক্ষোভও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বর্যার সময় ভোগান্তি বাড়তেই পুলিশ কর্মীরা সমস্যায় পড়েছেনয়। বিষয়টি নিয়ে ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা অফিসার, কনস্টেবলরা তো মুখ খুলতে চাননি, তেমনিই অনেক পুলিশ অফিসার, বিষয়টির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাখা সচিবালয় জড়িয়ে থাকায় প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন।
পুলিশ কমিশনারেটের একাংশ জানান, প্রদীপের নীচে অন্ধকার কাকে বলে এটা যেন তারই একটি দৃষ্টান্ত। পুলিশকর্মীরা দেখছেন, গত তিন বছর ধরে উত্তরকন্যা জুড়ে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে একের পর এক নির্মাণ কাজ চলছে। অথচ এখনও দুটি সাদামাঠা ঘরও বিরাট চৌহদ্দির কোথাও তৈরি করে দেওয়ার কেউ আগ্রহ দেখাননি। শুধু, নানা দফতরের ঠেলাঠেলি চলেছে।নকশায় আছে বলে বারবার আশ্বাস মিলছে। কবে তা বাস্তবে আসবে, কে জানে!’’ তাঁরা জানান, নিরাপত্তার কোনও ত্রুটি হলে এই ‘হাই সিকিউরিটি জোনে’র দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মীদের রেওয়াত করা হবে না। কিন্তু তাঁরা কী পরিবেশ থাকছেন, খাচ্ছেন তা নিয়ে কোনও সময়ই কেউ ভাবছেন না।
বিষয়টি জানতে পেরেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব’ও। তাঁর উদ্যোগেই শিলিগুড়িতে এই বিরাট শাখা সচিবালয়টি তৈরি হয়েছে। এদিন মন্ত্রী গৌতমবাবু বলেন, ‘‘উত্তরকন্যার পুলিশ ক্যাম্পটির অবস্থা ভাল নয় বলে শুনেছি। আমরা উত্তরকন্যায় আরও কিছু নির্মাণ কাজ করছি। প্রশাসনিক ভবন, অডিটোরিয়াম-সহ আরও কিছু ব্যবস্থা হচ্ছে। সেখানে পুলিশ ক্যাম্পটির জন্য ব্যবস্থা থাকবে। এ বছরের শেষ নাগাদ কাজ শেষ হয়ে যাবে।’’
শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারেট মনোজ ভার্মা পুলিশ কর্মীদের আশ্বস্ত করে দ্রুত পরিস্থিতি বদলাবে বলে দাবি করেছেন। পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘উত্তরকন্যার নিরাপত্তার জন্য পুলিশের বড় পরিকাঠামো তৈরি হবে। যতদূর জানি, নকশা বা টাকাও বরাদ্দ আছে। আলাদা ক্যাম্প, মূল গেটের পাশে পুলিশ কন্ট্রোল রুম তৈরির কথা রয়েছে। ধীরে ধীরে সব হয়ে যাবে। ততদিন ওই পুলিশ কর্মীদের একটু সমস্যা হচ্ছে ঠিকই। আমরাও বিভিন্ন মহলে কথাবার্তা বলছি।’’ কমিশনারেটের পুলিশ কর্মীরা অবশ্য জানান, মন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনারের কথা ঠিক হলেও আরও অন্তত ছয়-সাত মাস এইভাবে পুলিশ কর্মীদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। বিষয়টি প্রথম থেকে দেখলে এই প্রশ্নই উঠত না।
শাখা সচিবালয়ে ঢুকেই বাঁ পাশে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর (সিএমও), মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চেম্বার, লাউঞ্জ, চিকিৎসক এবং সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারের ঘর রয়েছে। এর সঙ্গেই প্রেস কর্নার। তার পিছনেই পাওয়ার গ্রিডের দফতরের দেওয়াল বরাবর পুলিশ ক্যাম্পটি রয়েছে। কয়েকমাস আগে পর্যন্ত এর উল্টোদিকের, একটি ভবনের নিচের দিকে খোলা অংশে পুলিশ কর্মীরা লোহার খাট পেতে থাকতেন। বর্তমানে দুটি ভাঙা টিন জোড়া দেওয়া কাচা ঘরে ২০ জন থাকেন। সেখানেই পরপর লোহার খাট, টেবিলে ক্যাম্প দফতর রয়েছে। তেমনিই পাশেই আলু পেঁয়াজের বস্তা রেখে পাশে একচিলতে কোণে প্লাস্টিক টাঙিয়ে রান্না করতে হয়। তবে সবচেয়ে খাকার অবস্থা শৌচাগারটির। আদতে সেটি শ্রমিকদের শৌচাগারই। গত ২৭ মে ভূমিকম্পে প্রায় গুড়িয়েই গিয়েছে। খোলা আকাশের নিচেই প্রায় শৌচকার্য করতে হয় পুলিশ কর্মীদের। কোনও শেড না থাকায় বরাদ্দ একটি গাড়িটিও রাস্তার ধারেই রাখা হয়।
২০১২ সালে উত্তরকন্যার কাজ শুরু হয়। প্রথম দফায় ৬০ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৬০ হাজার স্কোয়ার ফুটের ভবন তৈরি হয়। পরে প্রায় ১২ কোটি টাকা খরচ করে আরেকটি অত্যাধুনিক অতিথি নিবাসও হয়। উত্তরকন্যার ভিতরের নিরাপত্তার দায়িত্বে বেসরকারি একটি নিরাপত্তা সংস্থা রয়েছে। বাইরে এবং গোটা চত্বরের দায়িত্বে পুলিশ ক্যাম্পটি। রাজ্য সশস্ত্র বাহিনীর দ্বাদশ ব্যাটেলিয়ানের ওই পুলিশ কর্মীরা ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন। গত বছর জানুয়ারি মাসে উত্তরকন্যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে তিনি তো বটেই রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী প্রায়ই শাখা সচিবালয়ে এসে বৈঠক করেছেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর-সহ ২০ দফতরের অফিসও তৈরি হয়েছে।