স্নেহ: কোটরে চড়াই। ছবি: পীতাম্বর নেয়ার।
বাংলা থেকে বিলেত— তাদের জন্য সাদর আপ্যায়ন ছিল কবিদের কলমে। কিন্তু সেই চড়ুই-স্প্যারোরা এখন কোথায়? ক্বচিৎ-কদাচিৎ দেখা যে মেলে না, তা নয়। তবে অস্তিত্ব রক্ষার মরিয়া লড়াই চালাতে হচ্ছে তাদের।
শহর তো বটেই, গ্রাম থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে চড়ুই। শুধু এই ছোট্ট পাখিটি নয়, এক সময়ে রাস্তাঘাট, জলাশয়, বাড়ির আনাচেকানাচে তাদের সঙ্গে দেখা যেত শালিখ, বাবুই, বক, টুনটুনিকেও। তাদেরও খবর নেই বহু দিন। পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল তৈরির হিড়িকে তাদের থাকার জায়গায় টান পড়েছে। অভাব খাবারেরও। এই সব পাখির অস্তিত্ব-সঙ্কটের জন্য পরিবেশ দূষণকেও দায়ী করছেন পক্ষিবিশারদেরা।
মঙ্গলবার ছিল, বিশ্ব চড়ুই দিবস, ‘ওয়ার্ল্ড স্প্যারো ডে’। চড়ুইয়ের এই দিনে পাখিটিকে নিয়ে আশার আলোও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। চড়ুইদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে খাস কলকাতার চাঁদনি চকে, সল্টলেকে, উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ-বসিরহাটে, দিল্লি-বেঙ্গালুরুতে।
চড়ুই বনে-বাদাড়ে থাকে না। থাকে বাড়ির ঘুলঘুলি বা দেওয়ালের ফাঁকে। পুরনো বাড়ি ভেঙে ক্রমাগত বহুতল উঠতে থাকায় বাসা বাঁধার মতো ফাঁকফোকর পাচ্ছে না তারা। নতুন বাড়িতে ঘুলঘুলি উঠে যাওয়ায় বাসা তৈরি বা ডিম পাড়ার জায়গা নেই। তাই শহর থেকে চড়ুই কমছে বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদের চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যাল। ‘‘এই কারণে কলকাতা ও অন্যান্য বড় শহরেও চড়ুই
কমে যাচ্ছে,’’ বলেন অশোককান্তিবাবু। দানাশস্য,
পোকামাকড়ই চড়ুইদের খাবার। সেই সব খাবারের আকালের জেরেও চড়ুই কমছে বলে মনে করেন পরিবেশবিজ্ঞানী স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী।
অভিযোগ, মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণে চড়ুই মরে যাচ্ছে। জুওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা, পক্ষিবিশারদ সুজিত চক্রবর্তী অবশ্য বলছেন, ‘‘এর বিজ্ঞানসম্মত
প্রমাণ মেলেনি।’’ তবে একটু থাকা-খাওয়ার জায়গা পেলে চড়ুইয়েরা যে এই শহরেও থাকতে চায়, সল্টলেকে সুজিতবাবুর বাড়িই তার প্রমাণ। সেখানে নিত্যদিন চড়ুইয়ের ভিড়। বেড়াল তাড়াতে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন স্বয়ং সুজিতবাবু। চাঁদনি চক এলাকাতেও কাঠের বাক্সে চড়ুইয়ের বাসা করে দিয়েছেন এক দোকানদার।
চড়ুইকে ‘রাজ্য-পাখি’ ঘোষণার দাবি তুলে দিল্লিতে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। তার পর থেকে গত পাঁচ বছরে সেখানে চড়ুই বেড়েছে। বনগাঁয় ধৃতিমান, সুদীপ, কৌশিক, সুভদ্রা, নন্দিতার মতো ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বাড়িতে চড়ুইয়ের বাসা বাঁধা, গরমের দিনে মাটির পাত্রে জল রাখা, গাছে গাছে বাবুই পাখির বাসা বাঁধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। চড়ুই সংরক্ষণে প্রাণপাত করতে করতে বেঙ্গালুরুতে ‘স্প্যারোম্যান’ হয়ে উঠেছেন এডউইন জোসেফ নামে এক বৃদ্ধ।
নদী, বন, গাছপালায় ঘেরা উত্তর ২৪ পরগনায় চড়ুই, শালিখ, বাবুইয়ের পাশাপাশি ভিড় করে পরিযায়ী পাখিরাও। কিন্তু শিকারের জন্য কমে যাচ্ছিল পাখি। বসিরহাটের চারঘাটের পঞ্চায়েত প্রধান নাজিমা খাতুন জানান, তাঁরা এখন নিয়ম করে পাখি শিকার বন্ধ করেছেন। ঘরে ঘরে চড়ুই পাখির বাসা দেখভাল করা হচ্ছে। পাখির কলরব শুনতে এখন চারঘাটের বারঘরিয়ায় ইছামতীর পাড়ে ভিড় করেন শহুরে মানুষ। সেখানকার রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের ঘরে-বাইরে হাজার হাজার পাখি। ওরা আমাদের ভয় পায় না।’’
শিকার ছেড়ে খাঁচা থেকে উড়িয়ে দিয়ে পাখির সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন এই লখিন্দরেরাও। ঠিক যেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি ‘চরাচর’।