কর্মীদের সতর্ক করলেও কাগজকল নিয়ে চুপ মুকুল

কোনও অবস্থাতেই শিল্পোদ্যোগী ও ব্যবসায়ীদের উপরে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না বলে দলের নেতা-কর্মীদের ফের সতর্ক করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। শনিবার বর্ধমান জেলার নেতাদের নিয়ে যুবভারতী স্টেডিয়ামে আয়োজিত এক সাংগঠনিক সভায় ওই হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, “বর্ধমানের মতো কৃষি ও শিল্পনির্ভর জেলায় তোলাবাজি বা দাদাগিরি বরদাস্ত করা হবে না।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৪ ০২:৫৮
Share:

কাগজকলে নোটিসের ছবি তুলছে পুলিশ। শনিবার। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

কোনও অবস্থাতেই শিল্পোদ্যোগী ও ব্যবসায়ীদের উপরে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না বলে দলের নেতা-কর্মীদের ফের সতর্ক করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। শনিবার বর্ধমান জেলার নেতাদের নিয়ে যুবভারতী স্টেডিয়ামে আয়োজিত এক সাংগঠনিক সভায় ওই হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, “বর্ধমানের মতো কৃষি ও শিল্পনির্ভর জেলায় তোলাবাজি বা দাদাগিরি বরদাস্ত করা হবে না।”

Advertisement

মুকুলবাবু যে দিন বর্ধমানের নেতাদের সামনে এ সব কথা বলেছেন, তার ঠিক আগের দিন ওই জেলারই প্রতাপপুরে সিন্ডিকেটের দাপটে একটি কাগজকলের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবং সে জন্য সিপিএম এবং এসইউসি-র পাশাপাশি অভিযোগের আঙুল উঠেছে মুকুলবাবুর দলের কর্মীদের দিকেও। এ দিনের সভায় অবশ্য সেই প্রসঙ্গ তোলেননি মুকুলবাবু।

মুকুলবাবুর এ দিনের হুঁশিয়ারির পরেও তাতে কতটা কাজ হবে, তা নিয়ে ঘোর সংশয়ে তৃণমূল নেতৃত্বেরই একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, গত কয়েক বছর ধরেই মুকুলবাবু বা স্বয়ং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারেবারেই এ সব হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও সিন্ডিকেট-রাজ বন্ধ হয়নি। উল্টে তা আরও বেড়েছে! দুর্গাপুরের কাগজকলে কাজ বন্ধের জন্য তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল উঠলেও এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মুকুলবাবুর মন্তব্য, “এটা আনন্দবাজারের বিষয়। আমাদের বিষয় নয়।”

Advertisement

মুকুলবাবু নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে যা-ই বলুন, শনিবারেও কিন্তু ওই বন্ধ কাগজকলের পরিস্থিতি এতটুকু বদলায়নি। এ দিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার প্রধান ফটক বন্ধ। তার সামনে তৃণমূল, সিপিএম এবং এসইউসি তিন দলেরই পতাকা উড়ছে! অভিযোগ, ওই তিন দলেরই নেতারা নিজেদের লোক ঢোকানোর জন্য প্রথমে তদ্বির, পরে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এ দিন কারখানার নির্মাণকাজ দেখভাল করতে এসেছিলেন ওই সংস্থারই জম্মুস্থিত একটি ফেরো অ্যালয় কারখানার সুপারভাইজার রবীন দাস। তিনি বলেন, “তৃণমূল, সিপিএম, এসইউসি সব দলের তরফেই লোক নিয়োগ নিয়ে লাগাতার চাপ দেওয়া হচ্ছিল। বাধ্য হয়েই মালিক কাজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” যদিও এই অভিযোগ স্বীকার করতে চাননি সিপিএম এবং এসইউসি-র স্থানীয় দুই নেতা সুব্রত পাল ও বিপ্লব মণ্ডল। ওই দুই নেতার বক্তব্য, তৃণমূলের সমর্থকদের পাশাপাশি তাঁদের লোকজনকেও কাজ দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন তাঁরা। তবে, এর জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের উপরে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন দুই নেতা।

কারখানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, অসীম ঘোষ নামে এক শিল্পপতি বছর চারেক আগে কারখানাটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তিনি তা চালাতে না পারায় ব্যাঙ্ক সেটি বাজেয়াপ্ত করে। কারখানাটি নতুন করে খুলবেন বলে এ বছর জুনে পৌনে তিন কোটি টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে কারখানাটি কিনে নেন দিল্লির শিল্পপতি বাবুভাই খান্ডেলওয়াল। তার পরেই সীমানা পাঁচিল দেওয়ার কাজ শুরু হয়। আর সেই কাজ করতে গিয়েই একাধিক রাজনৈতিক দলের চাপের মুখে পড়েন কারখানা কর্তৃপক্ষ। রবীনবাবুর মন্তব্য, “এই মুহূর্তে আমাদের মাত্র পাঁচ জন কর্মী দরকার। অথচ, সবাই নিজের লোক ঢোকানোর দাবি করছেন! সে কথা একাধিক বার বিভিন্ন দলের নেতাদের বোঝানো হয়েছে।

কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনতে চাইছেন না।”

গত দু’দিনের পরিস্থিতি বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত কাল, সোমবার কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। শনিবার তিনি নিজেই এ কথা জানিয়েছেন। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত সংস্থার তরফে পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে কোনও লিখিত অভিযোগে দায়ের হয়নি। আসানসোল-দুর্গাপুরের এডিসিপি সুনীল যাদব বলেন, “আমাদের কাছে এখনও কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। কারখানার সামনে পুলিশ মোতায়েন আছে।” ম্যানেজার অর্ধেন্দু হাজরা পরে বলেন, “আজ, রবিবার ওই অভিযোগ দায়ের হবে।”

শুধু লোক ঢোকানোর দাবি নয়, নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের বরাত পাওয়ার জন্যও একাধিক নেতা কারখানা কর্তৃপক্ষের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন বলে সংস্থা-সূত্রে অভিযোগ। এবং সেই বরাত পাওয়া নিয়েই নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়েছে শাসক দলের দুই গোষ্ঠী। ওই নির্মাণকাজের বরাত পেয়েছেন যিনি, সেই ঠিকাদার মনোতোষ সেন চৌধুরীর অভিযোগ, “বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে নির্মাণ সামগ্রী নেওয়ার চাপ তো ছিলই। তার উপরে যত মাল দরকার, তার থেকে বেশি নিতে হবে বলে জোরজবরদস্তি চলছিল!” কারখানা সূত্রে জানা গিয়েছে, স্থানীয় তৃণমূল নেতা তাপস মণ্ডল এবং তাঁর দলবল নির্মাণ সামগ্রী নেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করেছিলেন। তাপসবাবু দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের তৃণমূল সভাপতি সুজিত মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তাপসবাবু

অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমার কোনও যোগ নেই। দু’পয়সা রোজগারের জন্য গ্রামের ক’জন মিলে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করতে চেয়েছিল।”

তাপসবাবুর এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরই দলের আর এক নেতা নিখিল নায়েক। তৃণমূলের অদক্ষ শ্রমিক সংগঠনের নেতা নিখিলবাবুর অভিযোগ, “এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী তাপস মণ্ডল ও সুজিত মুখোপাধ্যায়। সিন্ডিকেট-রাজ বন্ধের দাবি তুলে আমরা প্রতাপপুর এলাকায় দলীয় কর্মীদের নিয়ে মিছিল করেছি।” এর পরিপেক্ষিতেই সুজিতবাবুর তির্যক মন্তব্য, “তৃণমূলের বহিরাগতেরা এসে মিছিল করেই সমস্যা বাড়াচ্ছে।” গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তৃণমূলের অন্য যে নেতার নাম জড়িয়েছে, সেই মানস মণ্ডল বলেন, “স্থানীয়েরা যাতে কাজ পান, সেই দাবি-ই জানিয়েছি আমরা। কোনও চাপ দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমাদেরই দলের একাংশ নিজেদের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য সিন্ডিকেট-রাজ বজায় রাখতে চান। আমরা তা হতে দেব না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement