ভাঙা বাড়িতে দাঁড়িয়ে রফিকুলের মেয়ে ললিতা।
আবেগে কেঁদে ফেলেছিল বছর পনেরোর ললিতা। সেই ছবিরই নায়ক তাপস পাল গ্রামে আসছেন শুনে ছুটেছিল দেখতে। ভিড় ঠেলে কাছে যাওয়ার চেষ্টার ফাঁকেই কানে আসে তার বাবার নাম তুলে তাদেরই বাড়ি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন নায়ক। নায়কের হুমকির পরের দিনই, ১৫ জুন নাকাশিপাড়ার তেঘড়ি গ্রামে তৃণমূল কর্মীরা হামলা চালিয়ে ললিতাদের ঘর-বাড়ি ভেঙে দেন বলে অভিযোগ।
নদিয়ার নাকাশিপাড়ার চৌমুহা, তেহট্টের গোপীনাথপুরের পরে তেঘড়িতে তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের হুমকি-ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে বৃহস্পতিবার। বিষয় এবং বক্তব্যে যার সঙ্গে বীরভূমের পাড়ুইয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বিতর্কিত মন্তব্যের সাদৃশ্য পেয়েছেন অনেকে। মন্তব্য-পরবর্তী ঘটনাতেও মিল অনেকটাই।
তৃণমূল অবশ্য অভিযোগ মানতে চায়নি। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের ফিরদৌসি মণ্ডলের দাবি, “গ্রামের কিছু সিপিএম সমর্থক পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়েছিল। তাই পুলিশই এসে ওদের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে।” নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অজয় প্রসাদ “এ রকম কোনও ঘটনার কথা জানা নেই” বলে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। সদ্য প্রাক্তন পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র মন্তব্য করতে চাননি। নতুন দায়িত্ব পাওয়া পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ ফোন ধরেননি। এসএমএস করলেও জবাব মেলেনি। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও বলেন, “আমাদের কাছে এই ধরনের কোনও অভিযোগ আসেনি। পুলিশের কাছেও কি কোনও অভিযোগ করা হয়েছে?”
ভাঙা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ললিতা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, “নায়ক ভাঙচুরের হুমকি দেওয়ার সময় পুলিশ ছিল দাঁড়িয়ে। পর দিন ভাঙচুরের সময়ও পুলিশ ছিল সঙ্গে। কার কাছে অভিযোগ জানাব?”
নাকাশিপাড়ার দোগাছিয়া পঞ্চায়েতটি সিপিএমের দখলে। সেখানে সমাজবিরোধীদের উপদ্রব থাকায় পুলিশ ফাঁড়িও রয়েছে। ললিতার বাবা রফিকুল শেখ গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় তৃণমূলের হয়ে কাজ করেছিলেন। যদিও পঞ্চায়েতের দখল নেয় সিপিএম। এর পর তৃণমূলে কোণঠাসা হয়ে লোকসভা ভোটের সময় সিপিএমে যোগ দেন রফিকুল। ভোটের দিন গ্রামে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ বাধে। গোলাগুলি চলে। তৃণমূলের কয়েক জন সমর্থকের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ। রফিকুল-সহ সিপিএমের ১৫ জন কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। ঘটনার পর থেকেই রফিকুলরা পলাতক ছিলেন। তাঁরা গ্রামেরই একটি মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন শুনে ৯ জুন সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। রফিকুলরা বোমা-গুলি নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন বলে অভিযোগ। এর পরে বড় পুলিশবাহিনী গিয়ে কয়েক জনকে ধরে ফেলে। রফিকুল এখনও অধরা।
১৪ জুন তেঘড়িতে পৌঁছন তাপস পাল। সঙ্গে এলাকার তৃণমূল বিধায়ক কল্লোল খান। রফিকুলের নাম করে শুরুতেই সিপিএম-কে আক্রমণ করেন সাংসদ। বলেন, “আমি এমপি নই। অভিনেতা তাপস পাল। মানুষ তাপস পাল। আমি বলে যাচ্ছি কোনও সিপিএমের লোক এখানে থাকবে না।” রফিকুলকে ধরা হবেই দাবি করে সাংসদের পরামর্শ, “আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। আপনারা একজোট থাকুন। নিজেদের কাছে কুড়ুল রাখুন। ভোজালি রাখুন। আপনারা মারুন। তার পর কে আপনাদের জেলে নিয়ে যায় আমি দেখব।” এর পর সাংসদ জানতে চান, “রফিকুলের বাড়ি কোথায়?” ওই গ্রামেই বাড়ি শুনে বলেন, “আপনারা যদি বাড়ি ভেঙে দিতে পারেন, বুঝব দম আছে। আমি বলছি, বাড়ি ভেঙে দিন। কুড়ুল নেই? কুড়ুল দিয়ে ভেঙে দিন।” হাততালিতে ঢেকে যায় সাংসদের গলা।
সিপিএমের দাবি, পর দিন শুধু রফিকুল নয়, তাদের আরও জনা কুড়ি কর্মীর বাড়িতে চড়াও হয় ৩০-৩৫ জনের একটি দল। রফিকুলের বাবা বৃদ্ধ নুর মহম্মদ শেখের দাবি, “ওরা বলছিল, ‘সাংসদ বলে গিয়েছেন। দেখি তোদের কে বাঁচায়’?” প্রতিবেশী রিজিয়া বিবি জানান, বাড়ির পুরুষরা আগেই গ্রাম ছেড়েছিলেন। ছিল শুধু মেয়েরা। বাধা দিতে গেলে মেয়েদেরও মারধর করা হয়। গ্রামেরই আর এক সিপিএম সমর্থক আশাভানু বিবির ক্ষোভ, “জলের কলটাও ভেঙে দিয়ে গিয়েছে ওরা!” ওই ঘটনার পর থেকে সিপিএম সমর্থকদের চাষবাসেও বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। আবার গ্রামে ফিরতে টাকা দাবি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ শোনা গিয়েছে।
তেঘড়ির সিডিটি প্রকাশ্যে এনেছেন দোগাছিয়া পঞ্চায়েতের সিপিএমের উপপ্রধান আবদুল্লা মোল্লা। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে ফুটেজ ছিল। তা সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিয়েছি। টাকার বিনিময়ে কোনও ফুটেজ বিক্রি করা হয়নি। আমরা কোনও পয়সা নিইনি। তাপস পাল উচ্ছৃঙ্খল ভাষণ দিচ্ছিলেন। এতে এলাকায় অশান্তি হতে পারে। তাই ভয়ে ওই ক্যাসেট তুলে দিয়েছি। দেশের স্বার্থেই দিয়েছি। আরও কেউ চাইলে তাঁদেরও দেব। আমি চাই লোক জানুক, শাসক দলের নেতারা কী, তাঁদের মুখের ভাষা কী!”
ভাঙচুরের কথা বলছেন আশিদা বিবি।
সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, “এ ধরনের প্ররোচনামূলক মন্তব্যের পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা তেঘড়ির ঘটনাতেই স্পষ্ট।” তবে তৃণমূল বিধায়ক কল্লোল খান বলেন, “রফিকুলের ভয়ে আমাদের লোকেরা তটস্থ। ওর বাড়িতে হামলার সাহস আমাদের লোকেদের নেই। কে ভেঙেছে, প্রশাসনকে প্রশ্ন করুন।”
তেঘড়ির সিডি থেকে স্পষ্ট, ৯ জুনের গণ্ডগোলের কথা জেনেই ওই গ্রামে গিয়েছিলেন তাপস। যদিও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে তৃণমূল সাংসদ দলকে যে চিঠি লিখেছেন, তার প্রথম লাইনেই লেখা হয়েছে ‘নির্বাচনী প্রচারের তাপ-উত্তাপের মধ্যে’ তিনি এই মন্তব্য করেছেন। তারই সূত্র ধরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মন্তব্য করেছিলেন, “এক মাস আগের ঘটনা” নিয়ে এত শোরগোলের কারণ কী? এ দিনই বর্ধমানে কংগ্রেসের এক কর্মিসভায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর দল কত বড় নির্লজ্জ তা পদে-পদে বুঝিয়ে দিচ্ছে। না হলে দলের সাংসদ প্রকাশ্যে দলের ছেলেদের দিয়ে মহিলাদের ধর্ষণের কথা বলছেন। সেটা মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর দল সহ্য করছে কী করে?”
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।