Women Harassment

‘অথচ আমরা বলি মেয়েরা মায়ের জাত’

তিরিশ পেরনো ঝুমা ক্রিকেট বোঝেন না। আর মেয়ে দুটোর তো অতশত বোঝার বয়সই হয়নি। এই গেল বচ্ছরের কথা। বড়টা তখন সাত, আর ছোটটা সবে চার। কত ক্ষণে তারাবাতি জ্বালবে তা নিয়েই মেতে ছিল দুই বোন।

Advertisement

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:১১
Share:

স্মৃতিটুকুই সম্বল। —নিজস্ব চিত্র।

উফফ্ মাগো!

Advertisement

মাটির দাওয়া থেকে নামতে গিয়ে ঠোক্কর লাগল পায়ে। সুয্যি তখনও জাগেনি। তবে ঝুমার (নাম পরিবর্তিত) শুয়ে থাকার জো নেই। গরিব-গুর্বোর ঘর। কাজ গুছিয়ে মাঠের পানেও যেতে হবে।

কিসে হোঁচট খেল দেখতে গিয়ে দলা পাকিয়ে উঠল কান্না। সেই আধ-ভাঙা স্লেট! তার ঘষাটে কালো গায়ের মতোই নিকষ ছিল সেই রাত। অথচ জোড়া উৎসবের রাত ছিল সেটা। গ্রামে কালীপুজোর ভাসান। বিকেল গড়াতে না গড়াতেই বাজির চিড়বিড়ানি, ডিজের দপদপানি। ছেলেছোকরা ও আধ বুড়োদের কয়েকটা দল আবার বুঁদ ছিল টিভি আর মোবাইলে। সে দিনই ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল— ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া।

Advertisement

তিরিশ পেরনো ঝুমা ক্রিকেট বোঝেন না। আর মেয়ে দুটোর তো অতশত বোঝার বয়সই হয়নি। এই গেল বচ্ছরের কথা। বড়টা তখন সাত, আর ছোটটা সবে চার। কত ক্ষণে তারাবাতি জ্বালবে তা নিয়েই মেতে ছিল দুই বোন। কেউই কি তখন জানত যে ভাসান হয়ে যাবে চার বছরের কচি শরীরটারও!

‘‘মেয়েদের এই শরীরটাই সব চেয়ে বড় শত্তুর! আমার কোলের মেয়েটাকেও ছাড়ল না। অথচ আমরাই বলি মেয়েরা মায়ের জাত। ঘটা করে মায়ের পুজো করি।’’— কথাগুলো বলার সময় যন্ত্রণা ছাপিয়ে ঝুমার দু’চোখে অপার রাগ। কপালের শিরা দপদপ করছে। কালী প্রতিমা বিসর্জনের সেই রাতে প্রথমে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল ঝুমার ছোট মেয়ে। বাড়ির উঠোনে খেলতে খেলতে হঠাৎ নেই। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ।

পরে তাকে পাওয়া গেল পড়শি যুবকের ঘরে। ট্রাঙ্কের মধ্যে উপুড় করে রাখা দেহ। ঝুমা বললেন, ‘‘ভাবতে পারিনি, যাকে মেয়ে আমার আধো বোলে কাকু ডাকত, সেই ওকে এ ভাবে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলবে।’’ ধর্ষণের পরে ওই একরত্তিকে গলা টিপে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। কয়েক দিনের মধ্যে গ্রেফতার হয় সে। এখনও জেলেই রয়েছে।

জেলবন্দির বন্ধ দালানকোঠার দিকে তাকালে মেয়ের মুখটা দেখতে পান ঝুমা। সাড়হীন ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখ নয়, সেই ছুট্টে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া খিলখিলিয়ে হাসির মুখটা। বাড়ির কাছে অঙ্গনওয়াড়ি। ঝুমা জানালেন, ‘‘ছোটটা সেখানে যেত। খাবার পেত। ওদের বাবা তো রাজমিস্ত্রির লেবার। ঘরেই থাকে না। আমাকেও জন খাটতে যেতে হয়। লক্ষ্মীর ভান্ডার পাইনি এখনও।’’ অঙ্গনওয়াড়ি থেকেই অ-আ-ক-খ’র বই আর ওই স্লেটখানা দিয়েছিল। আর আছে মেয়ের একখান ছবি। মুখে সেই মনভোলানো হাসি। সব গুছিয়ে রেখেছেন ঝুমা।মনে আছে, গত বছরও দুই মেয়েকে নিয়ে ঠাকুর দেখেছিলেন। ঘুরেছিলেন মেলায়। তেমন কিছু কেনা হয়নি। তবু সব মনে আছে। স্মৃতিই তো থেকে যায়।

আর থাকে আগামীর অপেক্ষা। এখন বাতাসে শরতের গন্ধ। ঝুমার বাড়ির অদূরেও কাশের দোলা। উঠোনে ঝরা শেফালি। আর ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে।’

তবে ঝুমার জীবনের বাদল টুটেনি। বরং নিত্যকার জীবনযুদ্ধের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে মেয়েহারা মায়ের বিচারের লড়াই। মেয়ের খুনের মামলা চলছে পকসো আদালতে। হামেশাই প্রান্তিক এই গ্রাম থেকে মেদিনীপুর জেলা সদরে ছুটতে হয়। নিজেদের উকিল জোগাড়ের জো ছিল না। পুলিশই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অপরাধী তো ধরা পড়েছে? জেলে আছে? ‘‘সে জামিন পেলেই বেরিয়ে আসবে। যতক্ষণ না কোর্ট সাজা দিচ্ছে...’’— স্বস্তি নেই মায়ের।

আর জি করের ঘটনা শুনেছেন? সেখানেও কন্যাহারা বাবা-মায়ের বিচারের লড়াই?

ঝুমা এ বার বেশ সাবলীল। কোর্ট, বিচার, লড়াই— এ সব এখন তাঁর চেনা লব্জ। জবাব দিলেন, ‘‘সব শুনেছি। ওই ডাক্তারনির মা-ও তো কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, মেয়েটা মরার সময় হয়তো কত বার মাগো বলে চেঁচিয়েছে।’’ আবার ঝাপসা চারপাশ। আঁচলের খুঁট ভিজে। কাঁপা গলা বলে ওঠে, ‘‘ওর জন্য বিচার চেয়ে আমাদের এখানেও মিছিল হয়েছে। তবে ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারিনি, শরীরটা এখন ভারী লাগে তো!’’

ঝুমার শরীরে বেড়ে উঠছে আরও একটি প্রাণ। লোকে বলাবলি শুরু করেছে, আর যেন মেয়ে না হয়। ঝুমা অবশ্য মনেপ্রাণে চান, হারানিধি ফিরুক কোল আলো করে।

মেঘ সরিয়ে শরৎ শিশিরে ধোওয়া সেই প্রাণের আলো। কানে বাজুক সেই বোল—

মা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement