আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটেও কি নিচুতলায় সিপিএম-বিজেপির হাত ধরাধরি দেখা যাবে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে নিচুতলায় বাম-বিজেপি সমঝোতা রাজ্য জুড়ে শোরগোল ফেলেছে। নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি সমবায় নির্বাচনে রাম-বামের ‘বোঝাপড়া’ প্রকাশ্যে এসেছে। সেই ‘জোট’ অবশ্য সর্বত্র ফলপ্রসূ হয়নি। কোনও সমবায় সমিতিতে জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। কোথাও আবার তৃণমূলের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন জোট সমর্থিত প্রার্থীরা। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের নজর এড়িয়ে যে ভাবে তলে তলে সমীকরণ তৈরি হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতেই জল্পনা— আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটেও কি নিচুতলায় সিপিএম-বিজেপির হাত ধরাধরি দেখা যাবে?
সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছে, কোনও ভাবেই বিজেপির সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়াই করা যাবে না। দলীয় ‘লাইন’ না মানলে নিচুতলার সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে বলেও ‘লাল সতর্কতা’ জারি করা হয়েছে। সমবায় নির্বাচনে বাম-বিজেপি জোটকে নিছকই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসাবে দেখছে বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের বক্তব্য, শাসকদলের ‘লুটেরা’ বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা যে একজোট হওয়ার ডাক দিয়েছে, তাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিচ্ছেন মানুষ। বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সমঝোতা তারই ফল হয়ে থাকতে পারে। এই জোট তত্ত্বকে গুরুত্ব দিতে নারাজ শাসক তৃণমূলও। বরং সিপিএম-বিজেপি হাত মেলালে তাদেরই সুবিধা হবে বলে মত জোড়াফুল শিবিরের।
পূর্ব মেদিনীপুরে ক’দিন আগেই নন্দকুমারের বহরমপুর কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডে ভোট হয়েছে। দাবি, ওই ভোটে বিজেপি ও বামেরা নিজেদের মধ্যে আসন সমঝোতা করেছে। ওই সমবায়ে সব আসনেই জেতে ‘বিরোধী মঞ্চ’। যা কালক্রমে ‘নন্দকুমার মডেল’ হিসাবে পরিচিতি পায়। পঞ্চায়েত ভোটের আগে চর্চায় উঠে আসে নিচুতলার বাম-বিজেপি সমীকরণ। রাম-বাম জোটের তত্ত্ব প্রচারের আলোয় চলে আসায় তার আঁচ এসে পড়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেও। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অভ্যন্তরীণ কমিশন গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিপিএম নেতৃত্ব। যার প্রেক্ষিতে নিচুতলাকে সাফ বার্তা দেওয়া হয়, নন্দকুমার মডেলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়!
কিন্তু সেই বার্তা যে নিচুতলায় পৌঁছয়নি, তা-ই কার্যত স্পষ্ট হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের দু’টি এবং তমলুকের একটি সমবায় নির্বাচনে। দাবি, ওই তিনটি ভোটেও বাম-বিজেপির মধ্যে আসন সমঝোতা হয়েছে। তমলুকের খারুই গঠরা সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির নির্বাচনে জিততে এলাকার সিপিএম নেতৃত্ব বিজেপির হাত ধরে একসঙ্গে মিছিলও করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি। সমবায় ভোট একেবারেই স্থানীয় স্তরের এবং ‘অরাজনৈতিক’। এই নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হলেও রাজনৈতিক দলগুলি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে এর সঙ্গে জড়িয়েই থাকে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে দলের নিচুতলায় সত্যিই বিজেপির ‘ছোঁয়াচ’ লেগে গেল কি না, তা নিয়ে জল্পনায় স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে বাম নেতৃত্ব।
তবে সমবায় নির্বাচনের মতো পঞ্চায়েত নির্বাচনেরও বাস্তবতা হল, এই ধরনের ভোটে স্থানীয় ভিত্তিতে কার সঙ্গে কার জোট হবে, তার উপরে রাজনৈতিক দলগুলির শীর্ষ স্তরের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা থাকে না। উঁচুতলা নীতিতে অনড় থাকলেও নিচুতলা ‘বাস্তবতা’ দেখে। স্থানীয় বিষয়গুলিই বেশি প্রাধান্য পায় সেখানে। তার ভিত্তিতেই তৃণমূল স্তরে সমীকরণ তৈরি হয়।
এখন রাজ্যের সব জেলা পরিষদ এবং পঞ্চায়েত সমিতিও কার্যত নিরঙ্কুশ ভাবে তৃণমূলের দখলে। শাসকদলের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতি ও বেনিয়মের’ অভিযোগে সরব সব বিরোধী পক্ষ। ফলে, নিচুতলায় বিরোধী জোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাম আমলের শেষ দিকে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি পঞ্চায়েত ভোটে ‘মানুষের জোট’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন। সেই পথে হেঁটে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার এক ছাতার তলায় এসে লড়াইয়ের বার্তা দিচ্ছেন। সম্প্রতি বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কংগ্রেস, সিপিএম, এমনকি শাসকদলের ‘সৎ’ নেতাদেরও বিজেপির ঝান্ডার নীচে এসে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে জোট গড়ার ডাক দিয়েছেন। বিজেপির এক জেলা নেতা বলেন, ‘‘বামেদের মতো আমাদের সেই অর্থে কোনও ঘোষিত নীতি নেই। তৃণমূলের শাসনকালে গ্রাম বাংলার বহু মানুষ অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত। তাঁরা যদি আমাদের ঝান্ডার তলায় আসতে চান বা নিচু স্তরে হাত ধরাধরি করে চলতে চান, তা হলে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। এতে দু’পক্ষের শক্তিবৃদ্ধিও হয়। আর লক্ষ্য তো একটাই, শাসকদলকে ক্ষমতাচ্যুত করা।’’
জোট নিয়ে নিচুতলার বিজেপি নেতৃত্বের এমন ‘নমনীয়’ মনোভাবই সম্ভবত স্থানীয় বাম নেতৃত্বকে উৎসাহিত করছে। সিপিএম এক পা এগোলে বিজেপি দু’পা এগোতে রাজি থাকছে। তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে নন্দকুমারের ভোটে ‘সাফল্য’। এমন সম্ভাবনার কথা স্বীকার করে সিপিএমের এক জেলা নেতা বলেন, ‘‘এখনও দলের বহু কর্মী শীর্ষ নেতৃত্বের উপর ভরসা করতে পারছেন না। সেই ভরসা জোগাতে ব্যর্থ হচ্ছেন নেতৃত্ব। সেই কারণে শাসকদলকে ঠেকাতে নিচু স্তরে স্থানীয় নেতৃত্ব সঙ্গ খুঁজছেন।’’
তবে পাল্টা অভিমতও রয়েছে। অনেকের বক্তব্য, স্থানীয় বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে এই ধরনের জোট সর্বত্র সম্ভব নয়। পঞ্চায়েত স্তরে দলের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে গেলেই এই ধরনের অঘোষিত সমঝোতা হয়ে থাকে। সম্ভবত সেই কারণেই শুধু মাত্র পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সিপিএম-বিজেপির বোঝাপড়া দেখা গিয়েছে। আর যে হেতু জেলাটি ‘শুভেন্দুর জেলা’ বলেই সমধিক পরিচিত, তাই বিষয়টি বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদন না থাকলে রাজ্য জুড়ে এমন সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই তাঁদের দাবি।
স্থানীয় বাস্তবতার যুক্তি সিপিএম নেতৃত্ব স্বীকার করে নিলেও তাদের বক্তব্য, তৃণমূল এবং বিজেপিকে আটকানোর নীতি নিয়েই চলছে দল। তা অমান্য করে বিজেপি বা তৃণমূলের সঙ্গে দলের কেউ সমঝোতায় গেলে তা বরদাস্ত করা হবে না। গত সোমবারই বহরমপুরের প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের বাম-বিজেপি সমঝোতা নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। সিপিএমের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের ইডি-সিবিআই নিয়ে ভয় রয়েছে। তাই ওরা সমঝোতা করতেই পারে। সিপিএমের সে রকম কোনও ব্যাপার নেই। তাই নিচু স্তরেই হোক বা যেখানেই হোক, বিজেপি বা তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতা হলে দল কড়া পদক্ষেপ করবে। করেছেও। পূর্ব মেদিনীপুরে কয়েক জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’’ কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘স্থানীয় কারণে এই ধরনের জোট হয়ে থাকে। বৃহত্তর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এর কোনও গুরুত্ব নেই। আমরাও গুরুত্ব দিতে চাই না।’’
‘আনুষ্ঠানিক’ জোটের সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্বও। বরং এই ‘বোঝাপড়া’কে তাঁরা শাসকদলের বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই হিসাবেই দেখতে চাইছেন। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সমবায় নির্বাচনে স্থানীয় স্তরে লুট ঠেকাতে মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটে থাকতে পারে। তবে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ভাবে। ২০১৯-’২১ সালের রাজনৈতিক প্রবণতা বলছে, তৃণমূলকে একমাত্র বিজেপিই হারাতে পারে। সেই কারণেই বিজেপির ঝান্ডার তলায় অনেকে চলে আসছেন। একই ভাবে নিচুস্তরে জোটও হয়ে যাচ্ছে।’’
বিজেপি-সিপিএমের জোট নিয়ে অবশ্য ভাবিত নয় তৃণমূল। দলের সাধারণ সম্পাদক তথা পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় দলের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কুণাল ঘোষের মতে, ‘‘রাম-বামের প্রকাশ্যে জোট ওদের রাজনৈতিক মুখোশ খুলে দিয়েছে। মানুষের সত্যিটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি। তাই সব ক’টা সমবায়ে জোটের জয় হয়নি। গত লোকসভা নির্বাচন থেকে এটা হয়ে আসছে। এই প্রবণতা জারি থাকলে সুবিধেই হবে আমাদের। আমরা তো প্রথম থেকেই বলে আসছি, রাম-বাম সব এক। আমরা যেটা বক্তৃতা করে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সেটা ওরা জোট করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে।’’
পঞ্চায়েত ভোটে দলের কৌশল কী? দলের অন্যতম মুখপাত্র কুণালের জবাব, ‘‘আমরা প্রত্যেক বুথ থেকে ৫১-১০০ শতাংশ ভোট পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছি। বাকি সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশে জোট হল কি না, তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।’’