ঘটনাটা শোনা রাজ্য পুলিশের কাউন্টার ইনসারজেন্সি ফোর্স-এর এক অফিসারের কাছে। লালগড়ের পুব দিকে, পূর্ণাপানির জঙ্গলে তাঁদের সঙ্গে মাওবাদীদের সঙ্গে সে দিন প্রবল গুলির লড়াই চলছে। ২০১১-র মাঝামাঝি। মাওবাদীদের কব্জা করতে গুলিবৃষ্টি দরকার। কিন্তু হঠাৎই এক কনস্টেবলের ইনস্যাস রাইফেল থেকে গুলি বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল।
কী ব্যাপার, না ম্যাগাজিনে গুলি আছে ঠিকই, তবে লক্ড হয়ে গিয়েছে। যা কি না দেশজ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ইনস্যাস-এর সব চেয়ে বড় ত্রুটি। নাগাড়ে গুলি চালানোর পর হঠাৎই আটকে যায়। অথচ ভারতীয় সেনাদের স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল ইনস্যাস। কার্গিল যুদ্ধের সময়ে ইনস্যাস প্রথম ব্যাপক ভাবে সামনে আসে।
এর সতেরো বছর পরে, ইনস্যাস-এর দুর্বলতাগুলো ঢেকে, একে ফর্টি সেভেন-এর ভাল দিকগুলো নিয়ে দেশজ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুত করেছে ইছাপুর রাইফেল কারখানা। এক্সক্যালিবার। মধ্যযুগের কিংবদন্তী ব্রিটিশ রাজা আর্থারের ঈশ্বরপ্রদত্ত তলোয়ার এক্সক্যালিবারের নামে নামকরণ এই নতুন অস্ত্রের। আর এই নামেই মালুম, কতটা শক্তি ধরবে সে।
সূত্রের খবর, বেশ কিছু কাল ধরে প্রস্তুতির পর এই জুলাই মাসেই ইছাপুর রাইফেল কারখানায় তৈরি হয়েছে নতুন রাইফেলটি। কারখানার এক প্রযুক্তি অধিকর্তা জানালেন, প্রাথমিক ভাবে ১৫টি এক্সক্যালিবার তৈরিকরা হয়েছে। ওই কর্তার দাবি, পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করে খুশি সেনাবাহিনী। এর পর সেনার চূড়ান্ত স্তরের ছাড়পত্র মিললেই এর পুরোদস্তুর ব্যবহার শুরু হবে।
সেনা, আধাসেনা, সন্ত্রাসবাদী—সব পক্ষই সাধারণত একে ফর্টি সেভেন পছন্দ করে। কিন্তু সেটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি কালাশনিকভ রাইফেল। দাম যেমন বেশি, তেমনই বিদেশ থেকে আমদানি করার জন্য লাল ফিতের নানাবিধ ফাঁস আছে। সেই কারণেই কলকাতা পুলিশের হাতে বেশ কয়েক বছর ধরে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র আসা বন্ধ। ভারতের সেনা, আধাসেনা, পুলিশ কালাশনিকভ রাইফেলের প্রায় নকল, ভি জেড ফিফটি এইট-ও ব্যবহার করে। সেটিও সাবেক চেকোস্লোভাকিয়া তথা বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে তৈরি।
বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রের উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতেই অ্যাসল্ট রাইফেল ইনস্যাস (ইন্ডিয়ান স্মল আর্মস সিস্টেম) তৈরি করা হয় বহু গবেষণার পর। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি তখন বলেছিল, কালাশনিকভের চেয়েও এই রাইফেল অনেক ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হবে।
প্রথমত, ব্রাশ ফায়ার মোডে দিয়ে কালাশনিকভের ট্রিগার চাপলে এক লহমায় তিরিশটি বুলেটের ম্যাগাজিন খালি হবে। কিন্তু ব্রাশ ফায়ার মোডে ইনস্যাস থেকে এক সঙ্গে তিনটি গুলি বেরোবে। অর্থাৎ দ্রুত ম্যাগাজিন খালি হওয়ার সমস্যা থাকছে না। দুই, কালাশনিকভের ৭.৬২ বোরের গুলির চেয়ে ইনস্যাসের ৫.৫৬ বোরের গুলির ভেদশক্তি ইচ্ছাকৃত কম রাখার যুক্তি ছিল, এতে বহু ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ঘায়েল হবে। কিন্তু মরবে না। ফলে, আহতকে তুলে নিয়ে যেতে অন্তত দু’জন ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল, নাগাড়ে গুলি চালাতে গিয়ে প্রায়ই থেমে যাচ্ছে ইনস্যাস। এর ম্যাগাজিনটা স্বচ্ছ ফাইবারের তৈরি (ক’টা গুলি বাকি আছে, দেখা যায়) বলে শক্ত জায়গায় পড়ে গেলে বা ধাক্কা লাগলে ভেঙে যাওয়ার
আশঙ্কা। তা ছাড়া, কালাশনিকভের ম্যাগাজিনে যেখানে ৩০টি গুলি, ইনস্যাসের ম্যাগাজিনের গুলির সংখ্যা ২০। আর সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যে পরিমাণ ও মানের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র পৌঁছেছে, তাতে তার জবাব দিতে মাত্র তিনটি গুলির ব্রাশ ফায়ার উপযুক্ত নয়।কাজেই, এ বার এক্সক্যালিবার।
যার দৈর্ঘ্য ইনস্যাসের চেয়ে কিছুটা কম, ফলে ক্লোজ কমব্যাট বা স্বল্প দূরত্বের মুখোমুখি লড়াইয়ে উপযুক্ত। গুলি আটকে যাওয়ার সমস্যা নেই বলে দাবি করছে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি। পাল্লাও বেশি, সাড়ে চারশো মিটার।
দিল্লি থেকে সেনা সদর দফতরের এক মুখপাত্র বললেন, ‘‘ক্লোজ রেঞ্জে দ্রুত ও অবাধ গুলি চালানোর ক্ষেত্রে ইনস্যাসে কিছু সমস্যা ছিল। সেই দিকটায় বিশেষ নজর দিয়ে এক্সক্যালিবার তৈরির জন্য অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিকে জানানো হয়।’’ সেনার একটি সূত্রের খবর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী সংগঠিত হচ্ছে এক ছাতার তলায়, এক্স নাইনটি ফাইভ অ্যাসল্ট রাইফেল, ট্যাভর-এর মতো ইজরায়েলি আগ্নেয়াস্ত্রও তাদের হাতে পৌঁছে গিয়েছে। ফলে, এক্সক্যালিবার হাতে এলে তাঁদের সুবিধে হবে বলেই সেনা সূত্রটি জানাচ্ছেন।
সিআরপি-র কোবরা ইউনিটের এক কম্যান্ডোর কথায়, ‘‘ভারতীয় অস্ত্র বলে আমরা ইনস্যাসের গুণগান গাই ঠিকই। কিন্তু সত্যি বলতে কী, একে ফর্টি সেভেন হাতে থাকলে যে জোরটা মনে আসে, ইনস্যাসে সেটা হয় না। আশা করি, এক্সক্যালিবার সেই হীনমন্যতা ঘোচাতে পারবে।’’