অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুব্রত বক্সী। —ফাইল চিত্র।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কি তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন? শুক্রবার তৃণমূলেরই একটি নথি ঘিরে সেই জল্পনা শুরু হল।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক গত ১২ জুন তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে জানিয়েছিলেন, চিকিৎসার কারণে সংগঠন থেকে তিনি ‘সাময়িক বিরতি’ নিচ্ছেন। সেই সময় থেকেই বিবিধ জল্পনা চলছিল তৃণমূলের মধ্যে। তার মধ্যেই শুক্রবার রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর সাম্প্রতিক একটি চিঠি ঘিরে নতুন জল্পনা তৈরি হয়েছে যে, ২১ জুলাই তৃণমূলের ‘শহিদ স্মরণ’-এর বার্ষিক কর্মসূচিতে ধর্মতলার সভায় কি অভিষেক থাকবেন?
রাজ্য সভাপতি হিসেবে বক্সী চিঠি পাঠিয়েছেন দলের সমস্ত জেলা সভাপতি ও চেয়ারম্যানকে। বক্সী ছাড়াও সেই চিঠিতে রয়েছে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অরূপ বিশ্বাস এবং সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের নাম। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্লকে ২১ জুলাইয়ের প্রস্তুতি সভা করতে এবং ওই দিন যাতে ধর্মতলায় ‘রেকর্ড জমায়েত’ হয়, তা সুনিশ্চিত করতে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই চিঠিতে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের নামের কোনও উল্লেখ নেই। তা নিয়েই জল্পনা আরও জোরালো হচ্ছে তৃণমূলের অন্দরে। অতীতে যে ২১ জুলাইয়ের সভার এই ধরনের সাংগঠনিক চিঠিতে অভিষেকের নামোল্লেখ থাকত, তা নয়। কিন্তু গত ১০ মার্চ ব্রিগেড সমাবেশ উপলক্ষে জেলাগুলিকে একই রকম একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন বক্সী। দলীয় প্যাডে লেখা ওই চিঠিতে অভিষেককে ‘সেনাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। সেই কারণেই নতুন জল্পনা তৈরি। যদিও জয়প্রকাশ বলেছেন, ‘‘এ সব জল্পনা অর্থহীন।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘এই কর্মসূচির পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা সবই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে থেকে করেছেন এবং করছেন।’’ ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে অভিষেক সশরীরে থাকবেন বলেও দাবি তাঁর।
এমনিতে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে মমতাই ‘মূল তারকা’। এর আগেও ওই কর্মসূচির একটি পোস্টারে শুধু মমতারই নাম এবং ছবি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অভিষেক যে দলে ‘দু’নম্বর’, তা লোকসভা ভোটের পরে আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত। ফলে তাঁর অনুসারী এবং অনুগামীদের একটি অংশ বিষয়টি খুব সোজা চোখে নিচ্ছেন না। যদিও তাঁরা প্রকাশ্যে কেউই কিছু বলতে নারাজ। অন্তত এখনও পর্যন্ত। সমাবেশের এখনও বাকি প্রায় ২৫ দিন। তার মধ্যে ঘটনাপ্রবাহের দিকে সকলে নজর রাখতে চান।
তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, সংসদের চলতি অধিবেশন সেরে অভিষেক কলকাতায় ফিরবেন। তার পর বিদেশে যাবেন চোখের চিকিৎসার কারণে। কিন্তু কবে ফিরবেন, তা স্পষ্ট নয়। তৃণমূলের ওই সূত্রটিই জানাচ্ছে, পুরো বিষয়টিই নির্ভর করছে চিকিৎসকদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া এবং চিকিৎসাপ্রক্রিয়ার উপর। যে বিষয়ে অভিষেক কেন, কারও কোনও হাত নেই। তবে এটা ঠিক যে, অভিষেক ওই সভায় সশরীরে না-থাকলে আলোচনা এবং জল্পনা আরও বাড়বে। যদিও দলের এক প্রথম সারির নেতা জানাচ্ছেন, অভিষেক ২১ জুলাইয়ের সভায় সশরীরে থাকার সর্বতোভাবে চেষ্টা করবেন। প্রসঙ্গত, এ বারের ২১ জুলাইয়ের সভা লোকসভা ভোটের পরের ‘বিজয় উৎসব’ হিসেবেও একপ্রকার ধরে নিচ্ছেন দলের নেতা-কর্মীরা। যে ভোটে অভিষেক সারা রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক ব্যবধানে জিতেছেন। দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি তিনিও প্রচার এবং পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিশ্রম করেছেন। ভোটের আগের ‘প্রতিকূল’ পরিবেশে আলাদা কেন্দ্রবিরোধী ‘আখ্যান’ তৈরি করে হাওয়া ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন। ফলে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছে তৃণমূল।
কিন্তু তার পরেই তিনি ঘোষণা করে সংগঠন থেকে ‘সাময়িক বিরতি’ নিয়েছেন। কারণ, ‘চিকিৎসা’। আপাতদৃষ্টিতে এর মধ্যে ‘অন্য রকম’ কিছু নেই। সাংসদ হিসেবে অভিষেক নয়াদিল্লিতে তাঁর দায়িত্ব পালনও করছেন। বস্তুত, সংসদের অধিবেশনের সময়ে সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। স্পিকার নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী ঘোষণাকে ‘একতরফা সিদ্ধান্ত’ বলে সমালোচনা করেছেন। অতঃপর রাহুল গান্ধীকে তাঁর সঙ্গে লোকসভার মধ্যে বৈঠক করে এবং মমতার সঙ্গে ফোনে কথা বলে সেই ‘জটিলতা’ কাটাতে হয়েছে। ফলে অভিষেককে সংসদের অধিবেশনের সময়ে ‘সক্রিয়’ দেখিয়েছে। মনে হয়নি, তিনি ‘বিরতি’ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, রাজ্যে সরকারের কাজকর্ম যে ভাবে চলছে, তাতে তিনি ‘সন্তুষ্ট’ নন। তিনি মনে করেন, ‘পারফর্ম’ না করলে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মোকাবিলা শুধু সংগঠন বা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ দিয়ে করা যাবে না। এক শ্রেণির মন্ত্রী, আমলার প্রতি সরকারের ‘কঠোর’ মনোভাব নিতে হবে। যদিও এর কিছুই অভিষেক আনুষ্ঠানিক ভাবে বলেননি। কিন্তু ২১ জুলাইয়ের মতো দলের সর্ববৃহৎ কর্মসূচিতে দলের সেনাপতি এবং অন্যতম সংগঠক না-থাকলে এই জল্পনা যে আরও বাড়বে, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। এবং এ ক্ষেত্রে ‘ভার্চুয়াল’ উপস্থিতির চেয়েও সশরীর উপস্থিতি জরুরি।
গত বছর নভেম্বর মাস থেকে অভিষেক যে ভাবে সংগঠনের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ রচনা করেছিলেন, তা নিয়ে তৃণমূলে যথেষ্ট জলঘোলা শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে ঘোষণা করেই নিজেকে শুধু নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে ‘সীমাবদ্ধ’ রেখেছিলেন অভিষেক। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আস্তে আস্তে তিনি ফের সংগঠনের হাল ধরেন। ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে তিনি অনুপস্থিত থাকলে তা নিয়ে তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে আলোচনা হবেই। সে তাঁর অনুপস্থিতির কারণ যা-ই হোক।