জঙ্গিপুর আদালতে সুমিত্রা দেবী।— নিজস্ব চিত্র।
ভরা আদালতের মধ্যেই নাবালক তিন ছেলেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মহিলা। তারপর, কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্বামীর দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে উঠলেন— ‘‘হুজুর যাবজ্জীবন নয়, ওকে ফাঁসি দিন। বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই ওর।’’
থমথমে এজলাসে এ-ওর মুখ চাওয়া চাওয়ির মধ্যেই বছর দেড়েকের কোলের ছেলেকে নিয়ে ঝুপ করে বসে পড়লেন মহিলা। নাবালক অন্য দুই ছেলে তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কাঠগড়ার দিকে। যেখানে কিছু একটা বলতে গিয়েও কাঠগড়া আঁকড়ে ধরে চুপ করে গেল তাদের বাবা।
বৃহস্পতিবার সকালে ছবিটা মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আদালতের। খুনের দায়ে অভিযুক্ত টিঙ্কু মাহারের এ দিন সাজা ঘোষণা করেন বিচারক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। সকাল থেকেই এজলাসে ছিলেন টিঙ্কুর স্ত্রী সুমিত্রা। সঙ্গে দেড় থেকে সাত বছর বয়সী তিন ছেলে। বিচারক স্বামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি তিনি। তবে, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক অবশ্য সুমিত্রার দাবিতে বিশেষ আমল দেননি। বলেন, ‘‘স্বামীর ফাঁসি চাইলে হাইকোর্টে যান। সেখানেই যা বলার বলবেন।’’
পুলিশ জানাচ্ছে, ২০১৩-র ১২ ডিসেম্বর বাড়িতে ডেকে সুমিত্রার ভাই বাপ্পা দাসকে (১৭) কুপিয়ে খুন করে টিঙ্কু। বছর কয়েক আগে, বাপ্পাকে নিয়েই মুম্বইতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যায় টিঙ্কু। আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, শ্যালক-জামাইবাবুর বিবাদটা শুরু হয়েছিল ফিরে আসার পরে, হাজার কয়েক টাকা নিয়ে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বাপ্পার দাবি ছিল, টিঙ্কুর কাছে পাওনা ৯ হাজার টাকা চাইতেই তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকে জামাইবাবু। দু’জনের বেশ কয়েক বার বচসাও বাধে। কিন্তু তা বলে কুপিয়ে খুন? প্রশ্নটা তুলছেন সুমিত্রা। বলছেন, ‘‘সে দিন ফোনে ভাইকে ডেকে পাঠায় টিঙ্কু। আমি বাপের বাড়িতে ছিলাম। ভাইয়ের দেরি দেখে ফোন করতেই টিঙ্কুই ফোনে জানায়, ‘তোর ভাইকে তিন টুকরো করে কেটে দিয়েছি।’’
ছুটতে ছুটতে পাশের গ্রাম থেকে সাদিকপুরে এসে সুমিত্রা দেখেন পড়ে রয়েছে ভাইয়ের ছিন্ন দেহ। নিজের স্ত্রীকেও হাঁসুয়া দিয়ে খুন করতে গিয়েছিল সে। সুমিত্রা বলছেন, ‘‘গ্রামবাসীরা না ঠেকালে আমাকেও কুপিয়ে দিত।’’ ঘটনার প্রায় আট মাস পরে জঙ্গিপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করে টিঙ্কু। দীর্ঘ শুনানির পরে এ দিন সেই মামলার রায় দিলেন বিচারক।
বাবা নেই। ভাই খুন হওয়ার পরে স্বামীর ভিটেয় ফেরেননি সুমিত্রা। মা মঞ্জরীকে নিয়েই বিড়ি বেঁধে সংসার চালাচ্ছেন। বলছেন, ‘‘তিন ছেলেকে নিয়ে প্রয়োজনে ভিক্ষে করে খাব। কিন্তু যে মানুষটা এমন নির্মম ভাবে কাউকে খুন করতে পারে তার সঙ্গে থাকা যায়?’’ মঞ্জরীদেবী জানান, মামলা তুলে নিতে চাপ কম আসেনি সুমিত্রার উপরে। তিনি বলেন, ‘‘মেয়েটার অদম্য জেদ। ছেলে হারানোর দুঃখ চেপে এক সময় আমারও মনে হয়েছিল জামাইকে ক্ষমা করে দিই। সুমিত্রা মানতে চায়নি।’’
সাজা ঘোষণার পরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন টিঙ্কুর বাবা দাতারামবাবুও। বলছেন, ‘‘খারাপ লাগছে। তবে কী জানেন, ছেলে যা অপরাধ করেছে তা কি ক্ষমার যোগ্য!’’