Girl child

Girl Child: দুই শিশুকন্যা হত্যা উদাহরণ, দায়িত্বের স্বীকৃতি না পাওয়াই বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে নারীর জন্মের

‘মেয়ে আসলে দায়’, কেন এখনও এই ধারণা সমাজে? সেই কারণেই কি হত্যা? নাকি মানসিক বিকারের ঘাড়ে দোষ চাপালেই সবটা সারা হয়?

Advertisement

উদ্দালক ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৫৮
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

দেবীপক্ষ জুড়ে যখন নারী পূজিতা হচ্ছেন সর্বশক্তিমান রূপে, তখনই এক দিনে পর পর দু’টি ঘটনা। এক দিকে একবালপুরে মায়ের বিরুদ্ধে সদ্যোজাত মেয়েকে বালিশ চাপা দিয়ে খুনের অভিযোগ, অন্য দিকে বাঁকুড়ায় ১৬ দিনের কন্যাসন্তানকে মেরে মাটির তলায় পুঁতে দেওয়ার অভিযোগ বাবার বিরুদ্ধে!

Advertisement

কন্যাভ্রুণ হত্যা থেকে শুরু করে নারী জন্মের কারণে নানা অত্যাচার— এমন উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ। শহর থেকে গ্রাম, দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে সর্বত্র ঘটে যাওয়া এই ধরণের ঘটনা নিয়মিত প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে। এর পিছনে সামগ্রিক এক অপরাধপ্রবণতা হয়তো কাজ করে, কিন্তু পাশাপাশি থেকে যায় সমাজ-অর্থনীতির সঙ্গে নারীর যোগাযোগের বিষয়টিও।

‘মেয়ে আসলে দায়’, কেন এখনও এই ধারণা? সেই কারণেই কি হত্যা? নাকি মানসিক বিকারের ঘাড়ে দোষ চাপালেই সবটা সারা হয়?

Advertisement

মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের কথায়, ‘‘এটা তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধারাবাহিক ঐতিহাসিক ঘটনা। দেখুন না, উৎপাদনের সঙ্গে মহিলাদের সম্পর্ক এখনও কতটুকু? এ কথা ঠিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ আছে। কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমীকরণ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? রাজনীতিতেও বা এই সমীকরণে কোথায় দাঁড়িয়ে মেয়েরা? মহিলারা যে শ্রম দেন, তাঁদের কোনও মূল্যই দেওয়া হয় না। দায় বানিয়ে রাখা হয়েছে মেয়েদের! সামান্যতম স্বীকৃতিটুকুও দেওয়া হয় না।’’

পুরুষেরা যেমন বাইরে গিয়ে উপার্জন করছেন, মহিলারা বাড়িতে থেকে এমন অনেক কাজ সামলাচ্ছেন, যেটা তৃতীয় কাউকে দিয়ে করাতে হলে টাকা দিতে হত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

তা হলে উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যোগ না থাকাই কি নারী-জন্মকে ব্যর্থ করে তোলে?

এই হত্যার পিছনে মানসিক কারণ খুঁজতে নারাজ সমাজকর্মী অনুরাধা কপূর। তিনি বলছেন, ‘‘এই ধরনের হত্যার ঘটনা মানসিক বিষয় নয়, সামাজিক বিষয়। মেয়েরা শ্রমের মূল্য পান না। তাঁরা বাড়িতে যে কাজটা করেন, সেটারও তো একটা আর্থিক দিক আছে। পুরুষেরা যেমন বাইরে গিয়ে উপার্জন করছেন, মহিলারা বাড়িতে থেকে এমন অনেক কাজ সামলাচ্ছেন, যেটা তৃতীয় কাউকে দিয়ে করাতে হলে টাকা দিতে হত। সেটাকে কেউ স্বীকৃতিই দেয় না। সেই কারণেই সমাজের চোখে এখনও ‘দায়’ হয়ে আছে নারীজন্ম। নারীজন্মকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, কারণ মনে হয়, মেয়েটা দায়িত্ব নিতে পারবে না, বরং মেয়ের দায় নিতে হবে। কন্যা সন্তান হত্যা করার ঘটনা সেটিই প্রমাণ করে বার বার।’’

মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপও কিছুটা একই সুরে কথা বললেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এর মূলে রয়েছে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এখনও কন্যাকে পরিবারে ‘বোঝা’ মনে করা হয়। ‘কন্যা জন্ম পরিবারের কাছে আর্থিক বোঝা’, ‘চারপাশের সামাজিক-প্রশাসনিক-রাজনৈতিক অবস্থায় কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটা বড় সমস্যা’, ‘লালন-পালনের পর বিয়ে করে তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে!’, ‘কন্যাসন্তান বড় হয়ে পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব সে ভাবে নিতে পারে না-যতটা পারে পুত্রসন্তান’, মেয়েদের নিয়ে এগুলো এখনও চালু ধারণা।’’

গভীরে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান না করলে কোনওদিনই শিশুকন্যার উপর অত্যাচারের মাত্রা কমানো যাবে না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

রত্নাবলী অবশ্য মনে করছেন, গভীরে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান না করলে কোনওদিনই শিশুকন্যার উপর অত্যাচারের মাত্রা কমানো যাবে না। তাঁর কথায়, ‘‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী-র মতো প্রকল্প ক্ষমতায়নের অস্ত্র নিশ্চয়ই। কিন্তু তা গভীরে না গেলে কী করে হবে? এই প্রকল্পগুলি ক্ষমতায়নের পথে বড় পদক্ষেপ তো বটেই। কিন্তু মেয়ে জন্মের দায়ভারটা তো মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে।’’

পাশাপাশিই, কয়েকটি অন্য দিকের কথাও মনে করিয়েছেন মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী। এই হত্যাগুলিকে যে শুধু মাত্র মানসিক বিকার বলে চিহ্নিত করা যায় না, সে কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, কোনও দেশে মেয়েদের সন্তান জন্ম দেওয়ার বয়সের দিকে খেয়াল রেখে বলা যায় সেই সমাজে তাদের সম্মান কতটা! আমাদের দেশে কত মহিলা ১৬ বছরে মা হচ্ছেন! কেন? আর দিন দিন এই নিয়ে প্রতিবাদের পরিসরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। আসলে বিকৃত মানসিকতা দিয়ে এই ধরণের অপরাধকে ঢেকে আমরা সমাজ-রাষ্ট্রের দায় থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। রাষ্ট্র তো ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ বলেই খালাস। কিন্তু সে মানসিকতা আত্মস্থ হচ্ছে কোথায়? এর জন্য বিকল্প পরিবেশ তৈরি করতে হবে, তৈরি করতে হবে বিকল্প মূল্যবোধ।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement