(বাঁ দিকে) শনিবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর তাঁর বাসভবনের বাইরে এসে ডাকছেন জুনিয়র ডাক্তারদের। (ডান দিকে) আন্দোলনকারীদের ‘আর সম্ভব নয়’ বলে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ছাড়ছেন মন্ত্রী চন্দ্রিমা। ছবি: পিটিআই।
আরজি কর-কাণ্ড ঘিরে তৈরি হওয়া অচলাবস্থা কাটার আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতাতেই শেষ হল শনিবারের উদ্যোগ। দ্বিতীয় বার বৈঠকস্থলের দোরগোড়ায় পৌঁছেও কথাবার্তা ভেস্তে গেল। কেন এমন হল?
শনিবার দুপুরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে চলে যান আচমকা। ‘শেষ বারের মতো’ আলোচনার আর্জি জানান। তাতে সাড়া দিয়ে সন্ধ্যায় কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে চলে আসনে জুনিয়র ডাক্তারেরা। দীর্ঘ সময় ধরে নানা শর্ত নিয়ে টানাপড়েন চলার পরে যখন ‘সহমত তৈরি হব হব’, তখনই সরকারের তরফে ঘোষণা করে দেওয়া হয়— ‘আর নয়’। কেন এমনটা হল?
মুখ্যমন্ত্রী দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে ধৈর্য হারালেন? না কি অন্য কোনও কারণ? রবিবারও এ নিয়ে নানা মহলে আলোচনা। আলোচনা চলছে শাসকদলের অন্দরেও। ঘটনাচক্রে, যখন বৈঠক আর হবে না বলে জানানো হচ্ছে তার পিঠোপিঠি সময়েই আরজি করের ধর্ষণ ও খুনের মামলায় সিবিআই গ্রেফতার করেছে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে। প্রায় একই সময়ের দুই ঘটনার মধ্যেও কি যোগ রয়েছে? তা-ও আলোচনায়। কেউ কেউ মনে করছেন, গ্রেফতারির খবর পাওয়ার পরেই শনিবার আর বৈঠক না-করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ এই গ্রেফতারি আন্দোলনকারীদের যেমন উজ্জীবিত করেছে, তেমনই এটি সরকারের পক্ষে অস্বস্তির হয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিই বৈঠক না-করে সরকারের ‘পিছিয়ে যাওয়ার’ কারণ।
আর একটি অংশের মতে, তিন দিন ধরে জুনিয়র ডাক্তারেরা মুখ্যমন্ত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছেন। তাঁরও ধৈর্যের একটা সীমা রয়েছে। শনিবার ডাক্তারদের মঞ্চে নিজে গিয়ে তাঁদের আহ্বান জানানো, সন্ধ্যা থেকে বাড়িতে তিন ঘণ্টার অপেক্ষা, মাঝখানে বাইরে বেরিয়ে আন্দোলনকারীদের হাতজোড় করে অনুনয়, এত কিছু করার পরেও ডাক্তারদের ‘জেদ’ সরকারকে শেষ মুহূর্তে ‘কঠোর’ করে তুলেছিল।
শনিবার দুপুরে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই কালীঘাটের বৈঠকে সরাসরি সম্প্রচারে রাজি ছিলেন না। এমনকি, দু’তরফের ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়েও নয়। এই কথাটা জুনিয়র চিকিৎসকদের বারংবার বলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। পরে মমতা নিজেও ঘরে থেকে বেরিয়ে এসে একই কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রীর গোটা বার্তাটাই ছিল নরম স্বরে। তিনি যে আলোচনা চান সেটা বুঝিয়ে ছোট ভাই-বোনের মতো করে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেন। সরাসরি সম্প্রচার বা উভয় পক্ষের ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ে সমস্যা কোথায় তা নিজের মতো করে বারংবার বলেন। তিনিই প্রস্তাব দেন গোটা আলোচনা লিপিবদ্ধ করে সরকার ও আন্দোলনকারীদের পক্ষে সই করে রাখা হবে। যাতে পরে কোনও ভুল বোঝাবুঝি না-হয়। এর পরে মুখ্যমন্ত্রী ঘরে ঢুকে গেলে চিকিৎসকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। শেষে তাঁরা যখন মুখ্যমন্ত্রীর সর্বশেষ শর্ত মেনে আলোচনায় বসতে রাজি হয়ে যান, তখনই জানানো হয় ‘দেরি হয়ে গিয়েছে। আর সম্ভব নয়।’ এই সময়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও মুখ্যসচিব পন্থের সঙ্গে ছিলেন।
কিন্তু দিনভর যে আলোচনার জন্য দু’পক্ষই উদ্যোগী ছিল তা হল না কেন?
প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, তিন ঘণ্টার পরেও অপেক্ষা করলে এই জল্পনার অবকাশ থাকত যে, মুখ্যমন্ত্রী বেশি ‘নমনীয়’ হচ্ছেন। সকালে তিনি ধর্নাস্থলে গিয়ে নিজের ‘সদিচ্ছা’ প্রকাশ করেছেন। তার পর জুনিয়র ডাক্তারেরাই আলোচনার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের ‘দায়’ও কম ছিল না।
দ্বিতীয়ত, গোটা প্রশাসনের পদস্থ অফিসারেরা সকাল থেকেই বিষয়টি নিয়ে কর্মরত থেকেছেন। তাঁরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন অপেক্ষা করতে করতে।
আবার প্রশাসনের অন্য একাংশের মতে, এই বিষয়টি অন্য পাঁচটি সাধারণ প্রশাসনিক বিষয়ের মতো নয়। এটি একটি ‘সঙ্কট’। ফলে সঙ্কটকালের মতোই বিষয়টিতে বাড়তি সময় এবং মনোযোগ দিয়ে শনিবার রাতেই সেটির নিষ্পত্তি করার প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু তা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ বলেছিলেন, ‘‘বৈঠকের মিনিটস তৈরি করে দেব। সরকারের এক জন সই করবে, তোমাদেরও এক জন তাতে সই করবে। যারা আসতে চাও, আসতে পারো।’’ এর পরে জুনিয়র ডাক্তারেরা আলোচনা করে সওয়া ৯টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর শর্তে রাজি বলে জানান। নিরাপত্তাজনিত নিয়মমাফিক মোবাইল ফোন, ঘড়ি ইত্যাদি জমা দিতে তৈরি হন। তখনই জানিয়ে দেওয়া হয়, অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। পন্থ বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিমায় ‘কারণ’ জানালেও চন্দ্রিমার বলার ভঙ্গিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারীরা। সেই সময় ‘তোমরা চলে যাও, তোমাদের বাস ডেকে দিচ্ছি’ বলে জুনিয়ার ডাক্তারদের প্রতি চন্দ্রিমা মন্তব্য করেন বলেও আন্দোলনকারীদের দাবি। আন্দোলনকারীদের মতে, মন্ত্রীর মধ্য়ে একটা ‘অনিচ্ছুক’ মনোভাব রয়েছে বলে তাঁদের মনে হচ্ছিল, যা মুখ্যসচিবের কথাবার্তায় মনে হয়নি।
এই সময়ে চন্দ্রিমা জুনিয়র ডাক্তারর সঙ্গে যে ভাষা ও ভঙ্গিমায় কথা বলেন তা নিয়ে নানা মহলেই আলোচনা চলছে। রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘চন্দ্রিমার সঙ্গে মানুষের কোনও যোগাযোগ নেই। ডাক্তারদের আন্দোলন সম্পর্কে মানুষ কী ভাবছে তা নিয়ে কোনও ধারণা নেই। সেই কারণেই এই ঘটনা উনি ঘটাতে পেরেছেন।’’ ওই মন্ত্রীর আরও দাবি, ‘‘আমি যদি ওই জায়গায় থাকতাম তবে দিদিকে গিয়ে এক বার বলতাম, দিদি, ওরা লাইভ স্ট্রিমিং, ভিডিয়ো রেকর্ডিং ছাড়াও বৈঠকে রাজি হচ্ছে। চন্দ্রিমা সেই কাজ করেননি।’’
এখন কী বলছেন চন্দ্রিমা? মন্ত্রী এ সব সমালোচনায় কান দিতে চাইছেন না। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘কে কী বলছেন আমার জানার দরকার নেই। আমার কাজ আমি করেছি। কে আমাকে ভিলেন ভাবল, কে আমাকে নায়িকা ভাবল তা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না। কিন্তু মনে রাখবেন, শনিবারও তিন ঘণ্টা ধরে আমরা অপেক্ষা করেছি।’’