গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ছ’বছরে ছ’বার বদলেছে ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার। কিন্তু বদলায়নি ব্যারাকপুর!
সুনীল চৌধুরী, তন্ময় রায়চৌধুরী, মনোজ বর্মা, অজয় ঠাকুর, অলোক রজোরিয়ার পর আবার অজয় ঠাকুর। ২০১৯ সালের মে-জুন মাস থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে কমিশনারের ঘরে ঝোলানো পালিশ করা কাঠের বোর্ডে লেখা রয়েছে এই নামগুলিই। তার মধ্যে একটি নাম অবশ্য না থাকারই কথা— আইপিএস ডিপি সিংহ, যাঁকে ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার পদে নিযুক্ত করেও সেই নির্দেশিকা বাতিল করা হয়েছিল।
কমিশনারদের যাতায়াত চলেছে। কিন্তু ঘটনার ঘনঘটা বলছে, ‘বাঁকা’ ব্যারাকপুর সোজা হয়নি। গোলাগুলি, খুন, বোমাবাজি, বিস্ফোরণ লেগেই রয়েছে শিল্পাঞ্চলে। থামার নামগন্ধ নেই। সর্বশেষ নৈহাটিতে তৃণমূল কর্মীকে খুনের ঘটনা ঘটেছে। তার পরে পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে অলোককে সরিয়ে অজয়কে আনা হয়েছে। কিন্তু ব্যারাকপুর কি সোজা হবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, ব্যারাকপুর সোজা হচ্ছে না কেন?
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে থেকে যে রক্তঝরা এবং প্রাণহানি শুরু হয়েছিল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে, তা অব্যাহত ছিল ভোটের পরেও। ভোট মেটার পরেই ব্যারাকপুরের সিপি পদ থেকে সুনীলকে সরিয়ে তন্ময়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার আগে তন্ময়ের অভিজ্ঞতা ছিল হুগলি শিল্পাঞ্চলে দুষ্কৃতী দমনের। কিন্তু ব্যারাকপুরকে সোজা করতে পারেননি তিনি। অচিরে তাঁকেও সরে যেতে হয়। জঙ্গলমহল এবং দার্জিলিং সামাল দেওয়া মনোজকে ব্যারাকপুর ‘ঠান্ডা’ করতে পাঠায় নবান্ন, যাঁকে আরজি কর-পরবর্তী পর্বে কলকাতার সিপি করেছেন মমতা। পরিসংখ্যান বলছে, ব্যারাকপুরের সিপি হিসাবে গত ছ’বছরে খানিকটা সাফল্য পেয়েছিলেন মনোজই। শাসকদলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘‘মনোজই একমাত্র ব্যারাকপুরকে ঠান্ডা করতে পেরেছিলেন।’’ কিন্তু ২০২২ সালে মনোজকে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার পর থেকে ব্যারাকপুর ফিরতে শুরু করে ব্যারাকপুরে।
মনোজের সময়ে ব্যারাকপুর খানিকটা হলেও ‘ঠান্ডা’ হওয়ার নেপথ্যে আরও কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা রয়েছে শিল্পাঞ্চলের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলে। তার মধ্যে অন্যতম কারণের নাম অর্জুন সিংহ। বিজেপির হয়ে লোকসভায় জেতা অর্জুন ওই পর্বেই আবার তৃণমূলের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। কাকতালীয় হলেও সত্যি যে, ২০২২ সালে অর্জুন তৃণমূলে ফেরার পরেই মনোজকে ব্যারাকপুর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। অর্জুনের ‘দাওয়াই’ হিসাবে মাথা তুলেছেন তৃণমূলের সোমনাথ শ্যাম। শিল্পাঞ্চলে কথিত, তিনি এখন নানা দিক থেকেই ‘ক্ষমতাশালী’। অর্জুন তৃণমূলে ফেরার পরে সোমনাথের সঙ্গে তাঁর সংঘাত বারংবার প্রকাশ্যে এসেছিল। এ-ও শোনা যায় যে, তৃণমূলের হয়ে অর্জুন যাতে লোকসভায় টিকিট না পান, তার জন্য একাধিক বিধায়ককে নিজের দিকে শামিল করেছিলেন বিধায়ক সোমনাথ। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে যে খুনোখুনি চলছে, তার নেপথ্যে যেমন রয়েছে রাজনীতি, তেমনই রয়েছে কাঁচা টাকা। গঙ্গা থেকে তোলা বালি, পুরনো কারখানার জমি, নির্মীয়মাণ বহুতলের জন্য ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের পাশাপাশি হেরোইন ব্যবসা, সাট্টার ঠেকও জুড়ে রয়েছে সেই নগদ টাকার চক্রে।
অর্জুনের সঙ্গে সোমনাথের দ্বন্দ্বের মূল কারণ কী? শিল্পাঞ্চলের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের বক্তব্য, মিলের শ্রমিকদের ঠিকাদারি নিয়েই গন্ডগোলের সূত্রপাত। মেঘনা জুটমিলের নিয়ন্ত্রণ যেমন অর্জুনের হাতে, তেমনই অ্যালায়েন্স জুটমিল সোমনাথের ‘দখলে’। এলাকার লোকেরা জানেন, অর্জুন বিরোধিতার রাজনীতিকে পুঁজি করেই মূল স্রোতে এসে পড়েছিলেন সোমনাথ। ফলে ২০১৯ সালে অর্জুন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেই সোমনাথ যান তৃণমূলে। ঘটনাপরম্পরা দেখিয়েছিল, অর্জুন যে দিন বিজেপিতে যোগ দিলেন, ঠিক তার পর দিনই তৃণমূলের তৎকালীন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে জোড়াফুল আঁকা পতাকা নিচ্ছেন সোমনাথ।
কেন ব্যারাকপুর ঠান্ডা হচ্ছে না, এই প্রশ্নে সেই অর্জুন সরাসরি সমাজবিরোধীদের একটা অংশের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগ করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ টাকা নিয়ে সমাজবিরোধীদের খোলা মাঠ করে দিয়েছে। তাই সমাজবিরোধীরাই এখন পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করছে।’’ সোমনাথের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘ব্যারাকপুরকে অশান্ত করার নেপথ্যে রয়েছেন অর্জুনই। যদিও অনেকটাই হিংসা কমেছে। আগামী দিনে আরও কমবে।’’ ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের সিপিএম নেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায় আবার বলছেন, ‘‘ব্যারাকপুর নিয়ন্ত্রণ করছে গুন্ডারা। অর্জুন যখন সাংসদ ছিলেন, তখন তারা ছিল তাঁর সঙ্গে। এখন তারা তৃণমূলের পার্থ ভৌমিকের সঙ্গে। এখানে কে তৃণমূল, কে বিজেপি বোঝা মুশকিল। সবাই এক। আসল বিষয় হল লুটের ভাগ কে নেবে!’’
এ তো গেল আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। কিন্তু একান্ত আলোচনায় কী শোনা যাচ্ছে? শাসকদলের এক প্রভাবশালী নেতা একান্ত আলোচনায় বলছেন, ‘‘দুটো জিনিস কখনও প্যারালাল (সমান্তরাল) চলতে পারে না। যেখান থেকে ফান্ড কালেকশন (তহবিল সংগ্রহ) হবে, সেখানে পুলিশ সব ঠিকঠাক কাজ করবে, এটা হয় না। ব্যারাকপুর জুড়ে তা-ই হচ্ছে।’’ বাম জমানায় ব্যারাকপুরের সিপিএম সাংসদ তড়িৎ তোপদারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা গুন্ডা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ তুলতেন। এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘তখন তড়িৎবাবুর সঙ্গে অর্জুনের বোঝাপড়া ছিল। নতুন কোনও মাথা তৈরি হয়নি। ফলে সেই অর্থে সংঘাত ছিল না।’’ ব্যারাকপুরের রাজনীতিতে কথিতই ছিল, সিপিএম অর্জুনকে ভাটপাড়ার ‘মাঠ’ ছেড়ে রেখেছিল। ফলে তিনি বাকি অংশে সিপিএমকে ‘বিরক্ত’ করতেন না। বাম জমানাতেই অর্জুন ভাটপাড়ার চেয়ারম্যান এবং বিধায়ক ছিলেন। ঘটনাচক্রে, অর্জুন এখনও কোনও শুভ কাজের আগে তড়িতের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আসেন।
ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে রয়েছে মোট ২৩টি থানা এলাকা। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, এর মধ্যে ‘হট স্পট’ ৯টি থানা এলাকা। সেই তালিকায় রয়েছে নৈহাটি, ভাটপাড়া, জগদ্দল, হালিশহর (খানিকটা), ব্যারাকপুর, টিটাগড়, কামারহাটি, জেটিয়া (আংশিক), নোয়াপাড়া। পুলিশের একটি অংশের বক্তব্য, কাঁচা টাকা কেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে সার্বিক ভাবে বাহিনীর মধ্যেও ‘অস্থিরতা’ রয়েছে। একাধিক থানায় ঘন ঘন অফিসার বদল তার অন্যতম কারণ। আবার নির্দিষ্ট কিছু অফিসার নির্দিষ্ট থানায় থেকে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। প্রায় সব পক্ষই একান্ত আলোচনায় মানছে, ব্যারাকপুরের টাকাকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারার পরিবর্তন না হলে পরিস্থিতির সার্বিক কোনও বদল সম্ভব নয়। সিপি বদলে ব্যারাকপুরকে বদলানো যাবে না।
ব্যারাকপুর থেকে যাবে ব্যারাকপুরেই!