রাজ্যের এক মন্ত্রীর সাম্প্রতিক নাটকের নামটাই যেন বার বার ঘুরে ফিরে আসছে গোয়েন্দাদের মনে।
নাটকের নাম— ‘কে?’
গোয়েন্দাদের মতে, জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ ফের শুরু হয়েছে পুরনো কায়দায়, নিচু পর্দায়। কিন্তু তাঁদের প্রশ্ন, নেতাটা কে?
প্রায় এক যুগ নদীর উপরে সেতু গড়ার দাবি জানিয়ে জানিয়ে বীতশ্রদ্ধ গ্রামের মানুষ প্রশাসনের ভরসায় না থেকে নিজেরাই চাঁদা তুলে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছেন। গোয়েন্দাদের একাংশ এর মধ্যেও অন্য গন্ধ পাচ্ছেন।
পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডির ওই প্রত্যন্ত গ্রামে দরিদ্র মানুষদের সংগঠিত করল কে?
মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার হত্যা করেছে বলে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বেলপাহাড়ির এক সভায় মন্তব্য করেন। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সভাস্থল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে চিরাকুটি ও ১৫ কিলোমিটার দূরে জড়ামের মতো এলাকায় স্থানীয় মানুষ মাওবাদী পোস্টার দেখতে পেয়েছেন বলে খবর আসে গোয়েন্দাদের কাছে।
তড়িঘড়ি সাদা কাগজে আলতা দিয়ে পোস্টার লিখে রাস্তায় ফেলার নির্দেশ দিল কে?
লালগড় এলাকার একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের দুই নির্বাচিত সদস্যের এক জন ৫০ হাজার টাকা ও অন্য জন ২০ হাজার টাকা গত মাসে মাওবাদীদের দিয়েছেন বলে সিআরপি-র একটি সূত্রের দাবি। শুধু তাই নয়, ওই তল্লাটে একটি রাস্তা তৈরির দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে দেবার প্রতিশ্রুতিও মাওবাদীদের দিতে হয়েছে ওই দুই পঞ্চায়েত সদস্যকে।
আগের মতো চুপচাপ তোলা আদায়ের পরিকল্পনা ছকে দিল কে?
পুরুলিয়ার কাশীপুরে পাহাড় কাটার কাজ করছে একটি বেসরকারি সংস্থা। কিন্তু আশপাশের আট-দশটি গ্রামের মানুষ পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা রক্ষার দাবিতে ‘পাহাড় বাঁচাও কমিটি’ গড়ে আন্দোলনে নেমেছেন। এর আড়ালেও মাওবাদীদের ‘জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকারের’ স্লোগানই কিন্তু দেখছেন গোয়েন্দারা।
পাহাড় বাঁচাতে রাতারাতি কমিটি তৈরি, বহু সংখ্যায় মহিলাদের সামিল করার পিছনে কে?
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলছেন, ‘‘এই সব কাজ স্থানীয় ভাবে এক-এক জন নেতা করলেও মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে কোনও এক মাওবাদী শীর্ষনেতার হাতে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বা কোনও পলিটব্যুরো সদস্যকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেমনটা আগে ছিলেন কিষেণজি। কিন্তু এ বার কে?’’
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবি (ইনটেলিজেন্স ব্যুরো)-র এক কর্তার বক্তব্য, মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে আর নিছক গতিবিধিতে সীমাবদ্ধ নেই। তারা কাজকর্মও শুরু করেছে ধীর লয়ে। ওই অফিসারের মতে, কার্যকলাপ মানে এই নয় যে, মাওবাদীদের ল্যান্ডমাইন ফাটাতে হবে, গুপ্তহত্যা শুরু করতে হবে, নেতা বা পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের অপহরণ করতে হবে। বিভিন্ন স্থানীয় সমস্যায় গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ানো, আড়াল থেকে তাঁদের সংগঠিত করার মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেওয়াও মাওবাদী কার্যকলাপের অঙ্গ বলে ওই অফিসার জানান।
তবে আইবি-র ওই অফিসারের কথায়, ‘‘রাজ্যের মাওবাদী নেতাদের মধ্যে বিকাশ, আকাশ, রঞ্জিত পাল, জয়ন্তরা এখনও ফেরার। কিন্তু যে ভাবে জঙ্গলমহলে মাওবাদী কাজকর্ম শুরু হয়েছে, সেটা পরিচালনা ওদের সাধ্যের বাইরে। আরও বড় কেউ নেতৃত্ব দিচ্ছে।’’
এক গোয়েন্দা কর্তার বক্তব্য, ‘‘মাওবাদী শীর্ষনেতৃত্ব এমন কাউকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিয়েছে, যে ব্যক্তি আমাদের রেডারেই নেই। তার নামই হয়তো আমরা তেমন জানি না।’’
পুলিশ এ ক্ষেত্রে তিন মাওবাদী নেতার উদাহরণ টানছে। বাচ্চাপ্রসাদ সিংহ ওরফে বলরাজ, অমিতাভ বাগচি ও সুমিত সরকার। ভিন রাজ্যের বাসিন্দা বলরাজ পড়াশোনা করেছেন কলকাতার আশুতোষ কলেজে। বাংলা বলতেন ও লিখতেন বাঙালিদের মতোই। পরে গ্রেফতার হন উত্তর ভারত থেকে। আবার খাস শ্যামবাজারের বাসিন্দা অমিতাভ বাগচি মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বিহারের দায়িত্বে ছিলেন। ব্যারাকপুরের সুমিত সরকারও ভিন রাজ্যে সংগঠনের কাজ করেছেন দায়িত্ব নিয়ে। তিন জনেই অবশ্য এখন সংগঠনে নেই।
এক শীর্ষ গোয়েন্দা-অফিসার বলেন, ‘‘এই রাজ্যের কেউ দীর্ঘদিন বাইরে আছে বা বলরাজের মতো এই রাজ্য সম্পর্কে ভাল ভাবে জানে, এমন কেউই সম্ভবত দায়িত্ব পেয়েছে।’’ ওই পুলিশকর্তা স্বীকার করে নেন, ‘‘মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোয় হালফিলে কয়েক জন নতুন সদস্য নেওয়া হয়েছে। তাদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা অন্ধকারে।’’ কিষেণজি যেমন এক যুগেরও বেশি লালগড়ে পড়ে থেকে সংগঠন করার সুবাদে সেখানকার ‘বিমলদা’ হয়ে গেলেও ২০০৭-এর আগে তাঁর ব্যাপারে টনক নড়েনি পুলিশের।
মঞ্চে ‘কে’ নাটকে আড়ালে থাকা অপরাধীর স্বরূপ শেষ পর্যন্ত উন্মোচন হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে, জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের নতুন ভাবে সংগঠিত করা ও ফের কার্যকলাপ চালানোর নেতৃত্ব কে দিচ্ছেন, তার উত্তর এখনও হাতড়ে বেড়াচ্ছেন গোয়েন্দারা।