আশিস পাণ্ডে। ছবি: সংগৃহীত।
আরজি কর হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতি মামলায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা আশিস পাণ্ডেকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় থেকে আরজি করের ‘দাদা’ হয়ে উঠেছিলেন হাওড়ার ছেলে আশিস। তাঁর গ্রেফতারের পরে পরেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে, পাণ্ডের উত্থানের নেপথ্যে ‘পাণ্ডা’ কে? কার আশিসে আরজি কর চত্বর দাপিয়ে বেড়াতেন এই চিকিৎসক?
শাসকদলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, আশিসের মাথার উপর ছিল অনেকের হাত। তৃণমূলের রাজ্য স্তরের এক ছাত্রনেতার কথায়, ‘‘আশিসের উত্থানের নেপথ্যে যতটা না সরাসরি দলের কোনও নেতা ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিল চিকিৎসক লবি।’’ এই প্রসঙ্গেই ফের এক বার ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র প্রসঙ্গ আলোচনায় চলে আসছে। আরজি কর-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আশিস ছিলেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। যিনি উত্তরবঙ্গ লবির এক জন বলেই দাবি অনেকের। তবে আরজি করের বিষয়ে তৃণমূলের একাধিক ওয়াকিবহাল নেতার বক্তব্য, সন্দীপের চেয়েও বেশি করে আশিসের মাথায় ছিল শ্রীরামপুরের বিধায়ক তথা রোগীকল্যাণ সমিতির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুদীপ্ত রায়ের হাত। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য সুদীপ্তকে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ রয়েছে। মোবাইলে পাঠানো বার্তারও কোনও জবাব মেলেনি। উল্লেখ্য, আরজি করের আর্থিক দুর্নীতি মামলায় সিবিআই এবং ইডি— দুই তদন্তকারী সংস্থাই সুদীপ্তের সিঁথির বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে। সুদীপ্তের কন্যা সিজিও কমপ্লেক্সে গিয়ে নথিও জমা দিয়ে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে।
আশিস গ্রেফতার হওয়ার পরেই তাঁর নানা ‘কীর্তি’ মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করেছে। কী কী অভিযোগ রয়েছে আশিসের বিরুদ্ধে? এক, টিএমসিপির পদ ভাঙিয়ে হাসপাতাল, হোস্টেলে ‘দাদাগিরি’ চালানো। দুই, প্রাক্তন ছাত্রদের ‘ইউনিয়ন রুম’-এ তালা ঝুলিয়ে দেওয়া। তিন, ফেস্টের নামে অবৈধ ভাবে টাকা তোলা। চার, বেআইনি ভাবে কোয়ার্টারে হাউস স্টাফ বসানো। পাঁচ, আরজি কর চত্বরের বিভিন্ন স্টল থেকে তোলাবাজি করা। এ ছাড়া ওষুধ, মেডিক্যাল বর্জ্য, চিকিৎসার সরঞ্জাম কেন্দ্রিক যে সমস্ত দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাতেও আশিস যুক্ত বলে অভিযোগ। সন্দীপ, সুদীপ্তদের হয়ে আশিস-সহ বেশ কয়েক জনের বাহিনী কাজ করত বলেও অভিযোগ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বদলি, বিভিন্ন টেন্ডার থেকে সন্দীপদের হয়ে আশিস টাকা তুলতেন বলে অভিযোগ। আরজি কর হাসপাতালের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি ছিলেন বলে দাবি অনেকের। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কি সংগঠন কোনও পদক্ষেপ করছে? এ প্রসঙ্গে টিএমসিপির রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়ার জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে পাঠানো বার্তারও কোনও জবাব আসেনি।
আরজি কর হাসপাতালে ‘থ্রেট কালচার’ তথা হুমকি সংস্কৃতিতে যুক্ত অভিযোগে যাঁদের ইতিমধ্যেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তাঁদের মধ্যে আশিস ছিলেন অন্যতম। উল্লেখ্য, যে দিন তিনি হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন সে দিন বার হওয়ার পরে জুনিয়র ডাক্তারদের তাড়া খেয়েছিলেন। তার পর কোনও রকমে দৌড়ে সিআইএসএফের ভিড়ে চলে যান। তড়িঘড়ি ট্যাক্সি ধরে হাসপাতাল চত্বর ছাড়েন আশিস। যদিও জুনিয়র ডাক্তারদের অভিযোগ, আশিসই সে দিন তাঁদের হেনস্থা করেছিলেন। এই মর্মে তাঁরা টালা থানায় একটি অভিযোগও দায়ের করেছেন। আশিস যে আরজি করের ‘থ্রেট কালচারের’ অন্যতম হোতা ছিলেন, সেই দাবি করেছেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ শান্তনু সেনও। চিকিৎসক শান্তনুর মেয়েও আরজি করের ছাত্রী। শান্তনু বলেন, ‘‘এই আশিস আমার মেয়েকে মধ্যরাতে ফোন করে মানসিক নির্যাতন করেছিল। সেই অডিয়ো রেকর্ডও আমার কাছে রয়েছে। হাসপাতাল চত্বরে আমার মেয়েকে প্রকাশ্যে হুমকিও দিয়েছিল এই পাণ্ডা।’’
তরুণী চিকিৎসককে আরজি করের সেমিনার কক্ষে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার আগের রাতে আশিস উঠেছিলেন সল্টলেকের একটি হোটেলে। সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক মহিলাও। সিবিআই সেখান থেকে নথি সংগ্রহ করে। তার পর আশিসকে ডেকে সিবিআই জেরাও করেছিল। বৃহস্পতিবার তাঁকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। তাঁর গ্রেফতারির পর যেমন কৌতূহল তৈরি হয়েছে, আশিসের বাড়াবাড়ির নেপথ্যে কে? তেমনই শাসকদলের অনেক নেতাই একান্ত আলোচনায় বলছেন, আরও কত আশিস রয়েছে!