ফাইল ছবি
ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা রয়েছে। আছে এক গুচ্ছ কল্যাণ প্রকল্পে নিয়মিত মোটা টাকা খরচ করে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা। এর উপরে ডিএ (মহার্ঘ ভাতা) মামলায় হারের পরে সেই খাতে বিপুল অঙ্কের বকেয়া মেটানোর টাকা রাজ্য কোন ‘ভান্ডার’ থেকে জোগাড় করবে, কী ভাবে সামাল দেবে রাজকোষের উপরে এই চাপ, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই চিন্তার ভাঁজ প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের কপালে। তাঁদের মতে, পরিস্থিতি এমনই যে, এক দিক রক্ষা করতে গেলে, টান পড়তে পারে অন্য দিকে।
অর্থ-কর্তাদের মতে, শুক্রবার হাই কোর্টের দেওয়া রায় মেনে এখনই এই বকেয়া ডিএ মেটাতে বাড়তি প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে সরকারের। প্রশ্ন উঠছে, কী ভাবে সেই অর্থ জোগাড় করবে রাজ্য!
অর্থনীতিবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, ষষ্ঠ বেতন কমিশন চালু হওয়ার আগে এক কিস্তি ডিএ দিতে মাসে লাগত প্রায় ২৫ কোটি টাকা। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের পরে ডিএ-খরচ বেড়ে হওয়ার কথা মাসে ৬৪ কোটি টাকারও বেশি। সেই হিসাবে বছরে সরকারের খরচ হওয়ার কথা কমবেশি ৭৫০ কোটি টাকা। এই সূত্রে বকেয়া ৩১% ডিএ দিতে সরকারের বছরে ২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হতে পারে বলে তাঁদের দাবি।
রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির দাবি, আগে সপ্তম বেতন কমিশনের আওতায় কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরা ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে প্রায় ১০ দফায় এখন ৩৪% ডিএ পাচ্ছেন। ষষ্ঠ বেতন কমিশন কার্যকর হওয়ার পরে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩% ডিএ দেয় রাজ্য সরকারও। ফলে বকেয়া দাঁড়াচ্ছে ৩১ শতাংশে।
২০২২-২৩ আর্থিক বছরের বাজেটে বেতন খাতে সরকার খরচ ধরেছে প্রায় ৬০,৫২৩ কোটি টাকা। গত আর্থিক বছরের সংশোধিত বাজেটে তা ছিল প্রায় ৫৯,৫৬৮ কোটি। আবার পেনশন খাতে গত আর্থিক বছরের সংশোধিত বাজেটে সংস্থান ছিল প্রায় ২২,৫৩৮ কোটি টাকা। এ বছর ওই খাতে ধরা হয়েছে প্রায় ২২,৯৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বরাদ্দ খুব বেশি বাড়েনি। ফলে ডিএ-র এই বাড়তি টাকা জোগাড় পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ বলেই দাবি অর্থ কর্তাদের অনেকের।
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে জানাচ্ছেন, চলতি আর্থিক বছরের (২০২২-২৩) বাজেট প্রস্তাবে সব মিলিয়ে রাজ্যের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ ৯১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সামাজিক খাতে সম্ভাব্য খরচ প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা। সুদ-সহ ধার শোধের জন্য তুলে রাখতে হবে ৭০ হাজার কোটি।
শুধু ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পে প্রায় ১.৭৫ কোটি উপভোক্তার জন্য বছরে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে রাজ্যকে। মূল কল্যাণ প্রকল্পগুলিতে মোট প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এক অর্থনীতিবিদের কথায়, ‘‘মধ্যবিত্ত সরকারি কর্মীদের বকেয়া ডিএ মেটানো হবে, নাকি গরীব কল্যাণ প্রকল্পে খরচ করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত সরকারের। তবে দু’টো একসঙ্গে সামলানো খুব কঠিন।’’
কিন্তু তেমনই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ ও কর্মচারী মহলের অনেকের বক্তব্য, রাজ্য ক্লাব-অনুদানে কোটি-কোটি টাকা খরচ করে। লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথীর মতো কল্যাণ প্রকল্পও আয়ের মানদণ্ডে বাঁধলে, ‘অপচয়’ এড়ানো যেত। একমাত্র যোগ্য উপভোক্তারাই উপকৃত হতে পারতেন। সরকারি কর্মীদের ‘ডিএ-বঞ্চনা’র জন্য তাই কল্যাণ প্রকল্প যুক্তি হতে পারে না বলে তাঁদের দাবি। ডিএ-র অন্যতম মামলাকারী সংগঠন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্টস এমপ্লয়িজ়ের সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আদালত অবমাননা-সহ ছ’টি মামলায় জয়লাভের কৃতিত্ব কর্মচারীদেরই।’’ রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজয় শঙ্কর সিংহের কথায়, ‘‘মহার্ঘ ভাতা দয়ার দান নয়। এখনও রাজ্য যদি বকেয়া ডিএ দিতে গড়িমসি করে, তা হলে বৃহত্তর আন্দোলন ও সরাসরি সংঘর্ষের পথে নামতে বাধ্য হব।’’ সরকারি কর্মচারী পরিষদের রাজ্য সভাপতি দেবাশিস শীল বলেন, ‘‘আর টালবাহানা না করে সমস্ত বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দিক রাজ্য।’’ তবে তৃণমূল প্রভাবিত রাজ্য সরকারি কর্মী ফেডারেশনের প্রবীণ নেতা মনোজ চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েও বলছি, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় রাজ্যের পাওনা কেন্দ্র যথাসময়ে না দিলে, রাজ্যের আর্থিক সমস্যা প্রকট হয়। কেন্দ্রের উচিত বকেয়া সব অর্থ রাজ্যকে দ্রুত মিটিয়ে দেওয়া।’’
এ দিনের রায়ের পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তবে কি ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সময়কার বকেয়া ডিএ-ও মেটাতে হবে রাজ্যকে? প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ ছিল, কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিতে হবে রাজ্যকে। তৎকালীন রাজ্য সরকার তা মেনে নেয়। ২০১৬ সালে ষষ্ঠ বেতন কমিশন কাজ শুরু করে। ২০২০ সাল থেকে নতুন বেতন কমিশন কার্যকর হয়। তবে ষষ্ঠ বেতন কমিশন ডিএ-র সুপারিশ রাজ্যকে করেছে কি না, তা এখনও অষ্পষ্ট। এক অর্থ কর্তার কথায়, ‘‘ষষ্ঠ বেতন কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু সরকার তা এখনও প্রকাশ করেনি। ফলে ডিএ-র সুপারিশ রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়।’’ সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, আপাতত এই ডিএ-রায় হাতে পাওয়ার পরেও আরও আইনি পদক্ষেপ-সহ সমস্ত পথ খোলা রাখছে রাজ্য।