মাথার খোঁজে চলছে তদন্ত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘মাস্টারমাইন্ড’ কুন্তল ঘোষ। কুন্তল আবার বলছেন অনেকের নাম। প্রতিদিন নতুন নতুন সূত্র বেরিয়ে আসছে নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে। বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন নাম। তবে ইদানীং বিশেষ শোনা যাচ্ছে না দু’টি নাম। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। যাঁর ফ্ল্যাট থেকে নগদ টাকার পাহাড় উদ্ধার হয়েছে। তবে নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে সবচেয়ে বড় গ্রেফতারের ঘটনা এখনও পর্যন্ত সেটাই। সেখান থেকেই একটু একটু করে জট খুলেছে তদন্তের।
তবে কি পার্থ-অর্পিতার থেকে দৃষ্টি সরে গিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ড ডাইরেক্টরট (ইডি)-র? সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, তা নয়। তবে এটা ঠিক যে, এই মুহূর্তে তদন্ত যে জায়গায় রয়েছে, তাতে মূলত চারটি চরিত্রের বক্তব্য বিশ্লেষণ করছেন তদন্তকারীরা। মানিক ভট্টাচার্য, তাপস মণ্ডল, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুন্তল ঘোষ। যে ক্রমানুযায়ী নাম চারটি লেখা হল, নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে গুরুত্বের দিক থেকেও সেই ক্রমই ঠিক। মানছেন তদন্তকারীরাও। প্রকাশ্যে সে কথা না বললেও তদন্তের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে এখন এই চার জনের সঙ্গে নিরন্তর কথা বলেই খোঁজ চলছে আর এক চরিত্রের। সেই চরিত্র এক না হয়ে একাধিকও হতে পারে। তিনি বা তাঁদের কাছেই গিয়েছে চাকরি দুর্নীতির টাকার বড় অংশ।
অর্পিতার ফ্ল্যাটে বিপুল অর্থ উদ্ধারের পরেই নতুন মোড় আসে নিয়োগ তদন্তে। ফাইল চিত্র।
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত একটি নয়। অনেক রকম অভিযোগ। ফলে বিভিন্ন ভাগে চলছে তদন্ত। অনেককে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। কাউকে কাউকে ইডি। এর মধ্যে একটি ভাগে রয়েছেন পার্থ-অর্পিতা। আবার এসএসসি সংক্রান্ত অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে রয়েছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য, কল্যাণময় বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্পিতার বাড়িতে যে বিপুল অঙ্কের অর্থ এবং বহু মূল্যের অলঙ্কার উদ্ধার হয়েছে তাতে পরবর্তী কালে গ্রেফতার হওয়া মানিক, তাপস, শান্তনু, কুন্তলদেরও কি যোগ রয়েছে? তেমনটা হতে পারে বলেও মনে করছেন তদন্তকারীরা।
শান্তনুর সম্পত্তি এবং অন্যান্য নথি যাচাইয়ের পর ইডি মনে করছে, অনেক বড় ‘প্রভাবশালী’ যুক্ত রয়েছেন এই চক্রান্তে। তেমন ইঙ্গিত আদালতেও দিয়েছে ইডি। তারা জানিয়েছে, শান্তনুর দু’টি মোবাইল ফোনে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তা ‘সোনার খনি’। অর্থাৎ, গুরুত্বের দিক থেকে দামি। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, এমন কিছু নাম কেস ডায়েরিতে রয়েছে, যা প্রকাশ্যে বলা যাবে না।
সেই সব নামের মধ্যেই কি লুকিয়ে রয়েছেন নিয়োগ দুর্নীতির মূল মাথা বা মাথারা? যাঁরা টাকার বড় অংশের ভাগ পেয়েছেন!
গ্রেফতার হতে হয় তখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্যকে। ছবি: সংগৃহীত।
কুন্তল আর শান্তনুর মধ্যে কিছু ফারাকও ধরা পড়েছে ইডির নজরে। চাকরি বিক্রির টাকার ভাগ পেয়েছেন দু’জনেই। কিন্তু শান্তনু সেই টাকায় নিজের বা অন্যের নামে সম্পত্তি বাড়ালেও কুন্তল সে পথে হাঁটেননি। কুন্তল পয়সা ওড়ানো বা ভোগবিলাসে খরচ করেছেন। এখনও সে ভাবে সম্পত্তির খোঁজ মেলেনি। আবার হুগলির প্রবাদপুরুষ ‘গৌরী সেন’-এর মতো ‘দানধ্যান’-ও নাকি করেছেন। তাতেই কিছু পার্শ্বচরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে তদন্তে। তাঁরা অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত, নেল পার্লারের মালিক সোমা চক্রবর্তীরা। এঁরা সরাসরি চাকরি বিক্রির সঙ্গে যুক্ত না হলেও ওই দুর্নীতির টাকা পেয়েছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু শান্তনু তেমন নয়। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির টাকায় আর্থিক ভাবেও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন বলে অনুমান।
তদন্তকারীরা এমনও মনে করছেন যে, রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে শান্তুনুর ধারেকাছেও নেই কুন্তল। সেটা অবশ্য দু’জনের পরিচয়ই বলে দিচ্ছে। কুন্তল হুগলি তৃণমূলের যুবনেতা হিসাবেই পরিচিত। সেখানে শান্তনু হুগলি জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যুবা’ গঠনের পর শান্তনুই হুগলি জেলায় সেই যুব সংগঠনের প্রথম সভাপতি হন। পরে যুব তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি এবং পরে রাজ্যের যুব সহ-সভাপতি। ফলে ইডি আধিকারিকেরা মনে করছেন, শান্তনুর থেকে ধারে-ভারে অনেক পিছিয়ে কুন্তল। তাই শান্তনু যতই কুন্তলকে কাঠগড়ায় তুলুন না কেন, তদন্তকারীরা ততটা ভাবছেন না। বরং তৃণমূলের উচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে শান্তনুর যোগাযোগ বেশি ছিল বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও মঙ্গলবারই দু’জনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
সবার আগে গ্রেফতার হন প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ। ফাইল চিত্র।
মানিককে গ্রেফতারের পরে ইডি আরও কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চালায়। তখনই নাম আসে তাপস মণ্ডল এবং বিভাস অধিকারীর। এই দু’জনেই যুক্ত ছিলেন শিক্ষক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সংগঠনের মাথায়। দু’জনের সঙ্গেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিকের ‘সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ’ ছিল বলেও তদন্তে জানা গিয়েছে। ‘বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর দায়িত্ব পাওয়ার পরে তাপস আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। তদন্তকারীদের ধারণা, চাকরিপ্রার্থীরা যে হেতু বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য নানা কলেজে আসতেন, তাই কলেজগুলিই হয়ে ওঠে দুর্নীতির অন্যতম উৎসস্থল। এজেন্টরা এখানে সহজেই চাকরিপ্রার্থী পেয়ে যেতেন।
তাপসকে অনেক পরে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। তবে আগেই তাঁর বাড়ি থেকে অনেক নথি উদ্ধার করেছিল ইডি। পরে জেরায় জানা যায়, অনলাইনে ভর্তির সময় পার হওয়ার পরে টাকার বিনিময়ে বেআইনি ভাবে অফলাইনে ভর্তি করা হয়েছে অনেককে। তাপস সেই সময়ে দাবি করেন, লোক পাঠিয়ে তাঁর থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছেন মানিক। সেখানেই থামেননি তাপস। কুন্তলের নামও বলেন তিনি। তাঁর ডায়েরিতে নাম পাওয়া যায় কুন্তলের। টাকা বুঝে নিয়ে কুন্তল সই করেছেন বলেও দাবি করা হয়। সেখানে দেখা যায়, বড় বড় অঙ্কের টাকা কুন্তলকে দেওয়া হয়েছে। তাপস এমনও নাকি জানান যে, তাঁর কাছে কেউ টাকার বিনিময়ে যে কোনও চাকরির জন্য এলে তিনি ‘না’ বলতে পারতেন না। কিছুটা দয়াপরবশ হয়েই তিনি চাকরি পাইয়ে দিতেন। বিনিময়ে টাকা নিতেন।
অনেকেই বলছেন, হুগলির কুন্তলই নিতেন টাকা। ফাইল চিত্র।
ইডি এটাও মনে করছে যে, তাপস না থাকলে মানিক থাকতেন না। আর মানিক না থাকলে এই দুর্নীতিই হত না! কারণ, তাপস টাকা তুললেও মানিক না হলে চাকরিই দেওয়া যেত না ‘অযোগ্যদের’। কার টেটের নম্বর বাড়াতে হবে বা অন্য কোনও সুবিধা দিতে হবে, তার সবই হয়েছে টাকার বিনিময়ে। সেই টাকা গিয়েছে কুন্তলের কাছে। প্রাইমারি, আপার প্রাইমারির বাইরে বাম জমানায় চাকরি পেলেও স্থায়ী হতে না-পারা শিক্ষকেরাও (অর্গানাইজার টিচার) সুযোগ নিয়েছেন। এমন অনেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার করে টাকা নিয়ে স্থায়ী চাকরি দেওয়া হয়েছে। এতেও কোটি দশেক টাকার লেনদেন হয়েছে। তাপস দাবি করেন, সব মিলিয়ে তিনি কুন্তলকে ১৯ কোটি টাকা দিয়েছেন। সিবিআই সূত্রে জানা যায়, তাপস এমন দাবি করেছেন যে, ৩২৫ জন শিক্ষক পদপ্রার্থীর থেকে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা নিয়েছেন কুন্তল। বাঁকা পথে যুবনেতার কাছে সব মিলিয়ে ১৯ কোটি টাকারও বেশি পৌঁছেছে। তাপস সেই সংক্রান্ত কিছু তথ্যপ্রমাণও জমা দেন।
সেই সময় তাপসের মুখেই প্রথম শোনা যায় শান্তনুর নাম। কুন্তলকে তিনি অত টাকা কোন ভরসায় দিয়েছিলেন জানতে চাওয়ায় শান্তনুর কথা বলেন তাপস। কুন্তলই নাকি তাপসকে জানিয়েছিলেন, গোটাটা শান্তনুর মাধ্যমে হয়ে যাবে। তাপস আরও বলেন, সেই সময়ে শান্তনুর থেকে কুন্তল সম্পর্কে ‘ভাই আছে, দেখে নেবে’ বলে আশ্বাস পেয়েছিলেন তিনি। এই বয়ান অনুসারে তদন্তকারীরা মনে করছেন, শান্তনুর ভরসায় ‘ভাই’ কুন্তলকে টাকা দেন তাপস।
তবে গ্রেফতারের পরে কুন্তল আদৌ শান্তনুকে চেনেন না দাবি করেন। সেই সঙ্গে গোপাল দলপতি, নীলাদ্রি ঘোষেদের নাম বলেন। সেটা তিনি তদন্তকারীদের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য চেষ্টা করেছিলেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। শান্তনুকে বাঁচানোর চেষ্টাও ছিল তাঁর। কিন্তু শান্তনু গ্রেফতার হওয়ার পরেই আবার দাবি করে বসেছেন— দুর্নীতির ‘মাস্টারমাইন্ড’ কুন্তল। কিন্তু তদন্তকারীরা তা মনে করছেন না। তাঁরা বুঝেছেন, কুন্তলের তুলনায় অনেক বুদ্ধিমান এবং প্রভাবশালী শান্তনু।
কী ভাবে চাকরি কেনাবেচা হয়েছে সেই ‘কায়দা’ তদন্তকারীদের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেলেও তদন্তপ্রক্রিয়া এখনও প্রথম পর্যায়েই রয়ে গিয়েছে বলে দাবি। এর পরে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ভাগে আরও অনেক ‘কুশীলব’ সামনে আসবেন। গোটা দুর্নীতির সঙ্গে প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থের যোগাযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে তাতেও গতি আসতে পারে খুব তাড়াতাড়ি।
তবে সেই চরিত্রগুলি নিয়ে ধাঁধা এখনও কাটেনি। ইডি আধিকারিকরা অনেকেই মনে করছেন, টাকার মূল ভাগ যেখানে গিয়ে পৌঁছত, সেই জায়গায় তাঁদের পৌঁছতে এখনও খানিকটা সময় লাগবে। তার আগে ধৃতদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। দরকারে তদন্তকারী সংস্থাকে আরও গ্রেফতার করতে হতে পারে। তাঁরা কারা? ইডি সূত্র জানিয়েছে, সবুর করতে হবে।