চার বছর পরেও দগদগে ঘা। বাঙালি যুগল খুনে অভিযুক্তদের এক জনের ফাঁসির সাজা এবং তিন জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণায় ক্ষতে মলম পড়েছে ঠিকই, তবে এই রায়ে পুরোপুরি খুশি হতে পারছেন না উত্তরাখণ্ডে খুন হয়ে যাওয়া নিহত তরুণ অভিজিৎ পালের মা সন্ধ্যা পাল। তিনি বলেন, ‘‘কে কম দোষী, কে বেশি, আমার জানার দরকার নেই। আমার চোখে ওরা সকলে সমান অপরাধী। ছেলে আর তার বান্ধবীর সঙ্গে ওরা যা করেছে তা ক্ষমা করা যায় না। সকলের ফাঁসি হল না কেন?’’
কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়াকালীন দমদমের বাসিন্দা অভিজিৎ পালের সঙ্গে আলাপ হয় কল্যাণীর ঘোষপাড়ার বাসিন্দা মৌমিতা দাসের। আলাপ ধীরে ধীরে সম্পর্কের আকার নেয়। ২০১৪ সালে কর্মসূত্রে দু’জনেই দিল্লি পাড়ি দেন। দিল্লির একটি নামী কলেজে শিক্ষকতা করতেন মৌমিতা। অভিজিৎ একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। অক্টোবরে উত্তরাখণ্ড ঘুরতে যান ওই দু’জনে। সেখানেই মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে দু’জনের। দেহরাদূনের চাকরতায় টাইগার ফল্স দেখার জন্য রাজু দাস নামে এক জনের গাড়ি ভাড়া করেছিলেন অভিজিৎ এবং মৌমিতা।
শনিবার অভিজিতের খুড়তুতো ভাই জয় জানান, সন্ধ্যায় ফেরার পথে তিনটি ভিন্ন জায়গা থেকে বাবলু দাস, গুড্ডু এবং কুন্দনকে গাড়িতে তোলে রাজু। অপরিচিতদের গাড়িতে তোলা নিয়ে আপত্তি জানান অভিজিৎ। পুলিশকে জেরায় রাজু জানিয়েছে, তারা মত্ত অবস্থায় ছিল। প্রাথমিক ভাবে লুঠের পরিকল্পনা ছিল। সে কাজে অভিজিৎ বাধা দিলে তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করে দেহ খাদে ফেলে দেয় তারা। মৌমিতাকে ধর্ষণের পরে শ্বাসরোধ করে মারা হয়। দেহ যমুনার ব্রিজ থেকে জলে ফেলা হয়।
২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর থেকে অভিজিৎ এবং মৌমিতার কোনও খোঁজ পায়নি তাঁদের পরিবার। দিল্লির সাকেত থানায় মৌমিতার দাদা নিখোঁজ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের করলে উত্তরাখণ্ড পুলিশের সঙ্গে যৌথ ভাবে তদন্ত শুরু করে দিল্লি পুলিশ। মোবাইল ঘেঁটে জানা যায়, ঘটনার দিন রাজুর সঙ্গে সাত বার কথা হয়েছিল অভিজিতের। আইএমইআই নম্বরের সূত্রে জানা যায়, মৌমিতার ফোনে রাজু দাসের সিম ব্যবহার করা হয়েছিল। যার ভিত্তিতে রাজুকে জেরা করে সত্যিটা জানা যায়। একে একে গ্রেফতার করা হয় বাকি তিন জনকে।
এ দিন জয় বলেন, ‘‘আমরা যখন উত্তরাখণ্ডে যাই তখন ভাইয়ের দেহ সৎকার হয়ে গিয়েছিল। মৃতদেহের ছবি দেখে ভাইকে শনাক্ত করেছিলাম। যত দূর মনে পড়ছে মৌমিতার দেহের ময়না-তদন্ত হয়েছিল।’’
সাড়ে তিন বছরের আইনি লড়াই শেষে শুক্রবার সাজা ঘোষণা করে উত্তরাখণ্ডের নিম্ন আদালত। দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, তথ্যপ্রমাণের অভাবে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। খুন এবং ডাকাতির অভিযোগে সাজা ঘোষণা হয়েছে। রাজু যে হেতু মূল চক্রী তাই তার ফাঁসির নির্দেশ হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর সাক্ষী দিতে উত্তরাখণ্ড গিয়েছিলেন অভিজিতের ভাই জয়। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আদালতে এক এক করে চার জন ঢুকল। কারও মুখে কোনও অনুতাপ দেখলাম না।’’
সারা ঘরে ছেলের আঁকা ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারই মধ্যে বসে অভিজিতের মা বলেন, ‘‘এত বড় অপরাধের জন্য রাজুর মতো বাকি তিন জনেরও ফাঁসি চাই। তবেই শান্তি পাব।’’ মৌমিতার দাদা মৃগাঙ্ক দাস বলেন, ‘‘চার জনের ফাঁসি হলে আরও বেশি খুশি হতাম। তবে এক জনের যে হয়েছে, সেটাও কম পাওনা নয়। নিম্ন আদালতের রায় যাতে বহাল থাকে তার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব।’’