ড্রোন, ফাঁদ-খাঁচা কিছুই কাজে এল না, বল্লমে খুন দক্ষিণরায়

ক্যামেরা, ড্রোন, ফাঁদ-খাঁচা কিছুই কাজে এল না। বাঘবন্দিতে ব্যর্থ হল বন দফতর। শিকার উৎসবে জঙ্গলে যাওয়া আদিবাসী যুবকদের কারও ছোড়া বল্লমের ঘায়েই বাঘটির মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করছেন বনকর্তারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

চাঁদড়া শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:৩৬
Share:

গণদাবি: গাড়ির মাথায় বাঘের দেহ তুলে দেখাতে বাধ্য হলেন বনকর্মীরা। চলল ছবি তোলার হিড়িকও। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

জঙ্গলে পড়ে রয়েছে বিশাল ডোরাকাটা শরীরটা। কানের কাছে গেঁথে রয়েছে বল্লমের ফলা, রক্ত ঝরছে একটা চোখ থেকেও।

Advertisement

দেড় মাস আগে লালগড়ের পাতা ঝরা জঙ্গলে যার রাজকীয় হাঁটাচলা ক্যামেরাবন্দি হয়েছিল, শুক্রবার দুপুরে সেই রয়্যাল বেঙ্গলেরই দেহ মিলল মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাঁদড়া রেঞ্জের বাগঘোরার জঙ্গলে। ক্যামেরা, ড্রোন, ফাঁদ-খাঁচা কিছুই কাজে এল না। বাঘবন্দিতে ব্যর্থ হল বন দফতর। শিকার উৎসবে জঙ্গলে যাওয়া আদিবাসী যুবকদের কারও ছোড়া বল্লমের ঘায়েই বাঘটির মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করছেন বনকর্তারা। রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ বলেন, ‘‘অনভিপ্রেত ঘটনা। গোটা বিষয়টির তদন্ত শুরু হয়েছে।’’ বনসচিব চন্দন সিংহের বক্তব্য, ‘‘বাঘটিকে ধরার যাবতীয় চেষ্টা হয়েছিল। তাও কেন এমন হল, খতিয়ে দেখব।’’

বছর আটেক আগে সুন্দরবনে বাঘের দেহ ভেসে ওঠার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তৎকালীন ফিল্ড ডিরেক্টর এবং ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও কি কড়া পদক্ষেপ হবে? বল্লমের ঘায়ে যে বা যারা জাতীয় পশুকে খুন করল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে? বন দফতর সূত্রে খবর, সে দিকটিও দেখা হচ্ছে।

Advertisement

বাঘ-বৃত্তান্ত

• ৩১ জানুয়ারি: লালগড়ের জঙ্গলে বাঘের পায়ের ছাপ।

• ২৮ ফেব্রুয়ারি: বাঘের সন্ধানে বসে ফাঁদ ক্যামেরা।

• ২ মার্চ: মেলখেরিয়ার জঙ্গলে ক্যামেরা বন্দি বাঘ।

• ৩ মার্চ: সুন্দরবন থেকে বনকর্মীদের দল লালগড়ে।

• ৫ মার্চ: ঘরের উঠোনে বাঘ, মেদিনীপুরে দাবি স্থানীয়দের।

• ৭ মার্চ: বাঘ ধরতে ড্রোনে নজরদারির নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর।

• ৮ মার্চ: লালগড়ের জঙ্গলে ড্রোনের চক্কর।

• ১০ মার্চ: গোয়ালতোড়ে বাঘের হানায় জখম জয়রাম সরেন।

• ১৩ মার্চ: বাঘ ধরতে গিয়ে গোয়ালতোড়ে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু দুই বনকর্মীর।

• ৩০ মার্চ: চাঁদড়ার বাগঘোরায় বাঘের হানায় জখম তিন যুবক।

• ১৩ এপ্রিল: বাগঘোরায় প্রথমে আঁচড়ে জখম দুই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে উদ্ধার বাঘের দেহ।

এই বাগঘোরার জঙ্গলেই সপ্তাহ দুয়েক আগে তিন যুবক বাঘনখের আঁচড়ে জখম হয়েছিলেন। সে দিন নাগালে পেয়েও ধরা যায়নি বাঘটিকে। স্থানীয়রা দাবি করেছিলেন, জাল ছিঁড়ে পালিয়েছিল সে। এ দিন বাঘের দেহ পাওয়ার ঘণ্টা খানেক আগেও নখের আঁচড়ে জখম হন দুই আদিবাসী যুবক। স্থানীয় ও বন দফতর সূত্রের খবর, এর পরই জনা চল্লিশেক শিকারি বাঘের খোঁজ শুরু করে। নাগালে পেয়েও যায়। শিকারিদের কারও ছোড়া বল্লমের ফলা বাঘের ডান কানের নীচে ঢুকে যায়। শিকারিদের ছোড়া ইটের ঘায়ে জখম হয় বাঘের চোখ।

আরও পড়ুন: গ্রামকে জুজু দেখিয়েই বিপদ, উৎসবের ‘শিকার’ লালগড়ের বাঘ

কিন্তু বাঘটি প্রতিরোধ করল না কেন? বনকর্তাদের মতে, অচেনা এলাকায় এসে এমনিতেই ভীতু হয়ে পড়েছিল বাঘটি। আত্মরক্ষা ছাড়া তার আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তার ওপর খাবারের খোঁজে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। বনকর্তাদের ধারণা, এ দিন দুপুর একটা নাগাদ যখন শিকারিদের মুখোমুখি হয় রয়্যাল বেঙ্গল, তখন সম্ভবত সে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল। হঠাৎ সামনে এক দল মানুষ দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে, প্রথমে দু’জনকে জখম করলেও পরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তাই বল্লমের মুখে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

বল্লমে বিদ্ধ রয়্যাল বেঙ্গল। বাগঘোরায়। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

লালগড়ের বাঘ-পর্বের এমন ইতি কেউই চাননি। বাঘের খোঁজ থেকে যাঁদের রেহাই মিলল, সেই বনকর্তাদেরও মনখারাপ। জেলার এক বনকর্তা আবার মনে করালেন, যে পশ্চিম মেদিনীপুরের আরাবাড়ি বনাঞ্চল বনসুরক্ষায় দৃষ্টান্ত গড়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে, সেখানে মানুষের হাতে এ ভাবে জাতীয় পশুর মৃত্যু কাম্য ছিল না।

এ দিন বাঘের দেহ বাঁশে বেঁধে জঙ্গল থেকে বের করার সময় উৎসাহীদের ভিড়ে ছিলেন লক্ষ্মীমণি মাহাতো। মন খারাপ স্থানীয় এই বৃদ্ধারও। বললেন, ‘‘বাঘটা তো কাউকে মারেনি। অথচ আমাদেরই কেউ ওকে মেরে ফেলল। ঠিক হল না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement