মে দিবসের সকালে প্রয়াত হলেন মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ এবং রাজ্য বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র।
বয়সজনিত কারণে বেশ কিছু দিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন অশোকবাবু। বাড়িতে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভাঙার পর সমস্যা আরও বেড়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিংহোমে টানা বেশ কিছু দিন তিনি ভর্তি ছিলেন। সেখানেই মঙ্গলবার সকাল সওয়া ৯টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। অশোকবাবুর স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন ১০ বছর আগেই।
বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম প্রায় ১০ বছর অর্থ দফতরের ভার সামলে ছিলেন অশোকবাবু। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর কিছু মনান্তর হয়েছিল। মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট ভাবনা-চিন্তা এবং ‘বিকল্প অর্থনীতি’-র ভাবনা থেকে নিজেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করেননি। অসুস্থ শরীরেও ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলম চালিয়েছেন। সিঙ্গর-নন্দীগ্রাম পর্বে তৎকালীন বাম সরকারের নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, তিনি যে কমিউনিস্ট— এই পরিচয় কখনও ভোলেননি, ভুলতেও দেননি। সমালোচনা থাকলেও প্রকাশ্যে কখনও ব্যক্তি আক্রমণে যায়নি। এমনকী, বাম সরকারের নীতির সমালোচনা হলেও ২০১১ সালের আগে ‘পরিবর্তনপন্থী’ বিদ্বজ্জনেদের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করতে অসম্মত হয়েছেন।
চিরশয্যায় অশোক মিত্র। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। সাতের দশকের গোড়ায় সে দায়িত্ব ছেড়ে আসেন। তার পরে বাংলায় বাম সরকার এলে অশোকবাবুকে অর্থ দফতরের ভার দেন জ্যোতিবাবু। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার এবং ‘অপারেশন বর্গা’-র সময় অর্থ দফতরের হাল ছিল অশোকবাবুর হাতে। প্রথম বার রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে জিতলেও ১৯৮২-র নির্বাচনে সেখানেই তাঁর পরাজয় হয় কংগ্রেসের হৈমী বসুর কাছে। সেই সময় বামফ্রন্ট সরকার তাঁকে শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব দেয়। যে কমিশনের সুপারিশ মেনে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুল থেকে তুলে দেওয়া হয় ইংরেজি। পরে প্রবল বিতর্ক এবং প্রতিবাদের মুখে বাম সরকার ইংরেজি ফিরিয়ে আনলেও অশোকবাবু ছিলেন তাঁর মতে অনড়। তিনি মনে করতেন, শিশুদের ভাবনার বিকাশের জন্য মাতৃভাষাই সেরা মাধ্যম। যদিও রটরডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ ডি অশোকবাবু বাংলা এবং ইংরেজি— দুই ভাষাতেই সমান দক্ষতায় কলম লিখতেন।
ইংরেজির মতোই উদার অর্থনীতির প্রশ্নেও অশোকবাবু বরাবর কট্টরপন্থী অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংহকে কদর করতেন, ব্যক্তিগত সখ্য ছিল, কিন্তু ভারতে নব্য উদারবাদ টেনে আনার জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর তিনি সমালোচকও ছিলেন।
আরও পড়ুন
যে কোনও দিন শেষ হয়ে যাব, বলত শাহ
অশোক মিত্রকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শঙ্খ ঘোষ-সহ শহরের বিশিষ্টজনেরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
নীতিগত প্রশ্নে কট্টরপন্থী ছিলেন বলেই হয়তো অপ্রিয় কথা মুখের উপর বলে দিতেন। সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল অনেক দিন। সেই ’৮২-তে রাসবিহারীতে হারের পরে যাদবপুর থেকে উপনির্বাচনে জিতে ফের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেখান থেকে ইস্তফার পর্বের পরে নয়ের দশকে সিপিএম তাঁকে পাঠিয়েছিল রাজ্যসভায়। আর চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রে এক বার সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে ছিলেন। সংসদীয় রাজনীতির এই পাট চুকে যাওয়ার পরে গত প্রায় বিশ বছর তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন লেখালিখিতেই।