বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার হাত থেকে লগ্নিকারীদের স্বার্থরক্ষার প্রাথমিক ব্যবস্থা রাজ্যগুলিকেই করতে হবে বলে জানিয়ে দিলেন সেবি-র চেয়ারম্যান ইউ কে সিন্হা। তাঁর বক্তব্য, এই জাতীয় প্রতারণা রুখতে রাজ্যগুলিকেই নিজেদের আমানত সুরক্ষা আইন পাশ করাতে হবে। তাঁর কথায়, “অন্তত ৭টি রাজ্য এখনও এই আইন পাশ করায়নি।” রাজ্য সরকার সূত্রের খবর, সেই ৭টি রাজ্যের তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গও।
সারদা কেলেঙ্কারি আদৌ তাদের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় নয়, সেবি জানিয়েছিল এক সময়। যুক্তি ছিল, বেআইনি লগ্নি সংস্থার কাজকর্ম রুখে দেওয়ার মতো যথেষ্ট আইনি ক্ষমতা তাদের নেই। মনমোহন সিহের সরকার এর পর অধ্যাদেশ জারি করে বাড়তি ক্ষমতা দেয় কেন্দ্রীয় বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির হাতে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার যা আইনে পরিণত করেছে। বাড়তি ক্ষমতা পাওয়ার পরেও সেবির চেয়ারম্যান ইউ কে সিন্হা কিন্তু আজ বুঝিয়ে দিলেন, সারদার মতো সংস্থাগুলির প্রতারণার ফাঁদ থেকে সাধারণ লগ্নিকারীদের রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব রাজ্যগুলিরই।
সিন্হার কথায়, “রাজ্যের এই আমানত রক্ষা আইনের সাংবিধানিক বৈধতা আছে।” তাঁর বক্তব্য, “জাতীয় আর্থিক নীতি কেন্দ্রের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। সে কারণে আমানত সুরক্ষায় রাজ্যের নিজস্ব আইনের বৈধতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, লগ্নিকারীদের স্বার্থ রক্ষায় রাজ্যগুলির পদক্ষেপ করার অধিকার আছে।” সম্প্রতি সব রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সিন্হা ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর। সেবি চেয়ারম্যানের বক্তব্য, “রাজ্যগুলিকে জানিয়েছি, আমরা রাজ্য আমানত রক্ষা আইনে বেআইনি লগ্নি সংস্থার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করা যায়। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ প্রতারকদের গ্রেফতার করতে পারে। তাই বেআইনি লগ্নি সংস্থা রুখতে রাজ্যগুলিকেই প্রাথমিক দায় নিতে হবে।”
রাজ্য সরকারি সূত্রে খবর, এখনও পশ্চিমবঙ্গে আমানত রক্ষা আইন নেই। ‘চিটফান্ড’ নিয়ন্ত্রণে একটি আইন আনার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রের অনুমোদন না পাওয়ায় সেই চেষ্টা আপাতত ঝুলে রয়েছে।
সেবি চেয়ারম্যান সিন্হা রাজ্যগুলির দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও সারদা কেলেঙ্কারির বিভিন্ন পর্বে বাজার নিয়ন্ত্রক এই কেন্দ্রীয় সংস্থার ভূমিকা নিয়েও ইতিমধ্যেই একাধিক বার প্রশ্ন উঠেছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, সেবি-র কিছু কর্তার সঙ্গে সারদার যোগাযোগ ছিল। যোগসূত্র ছিলেন ধৃত ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু। সিবিআইকে লেখা চিঠিতে সুদীপ্ত সেন জানিয়েছেন, খোদ ইউ কে সিন্হার সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ আছে বলে নিতু তাঁকে জানিয়েছিলেন।
সারদা মামলার একটি পর্বে সেবি জানিয়েছিল, এই সংস্থার কাজকর্ম তাদের এক্তিয়ারে পড়ে না। কারণ, এই সংস্থা ‘চিটফান্ড’। তাদের কাজকর্ম চিটফান্ড আইনের আওতায় পড়ে। ওই ধরনের সংস্থা বেআইনি কাজ করলে তা নিয়ন্ত্রণের দায় রাজ্য পুলিশের।
সারদা মামলার আবেদনকারীরা পাল্টা জানান, সেবি ঠিক কথা বলছে না। কারণ, সারদার বিরুদ্ধে সেবি ইতিমধ্যেই নির্দেশ জারি করেছে। এক্তিয়ারের মধ্যে না থাকলে কী ভাবে ওই নির্দেশ জারি করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আবেদনকারীরা। পরে সেবি এই বিষয়ে নিজেদের ভুল মেনে নেয়। কিন্তু সেই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানায়, বেআইনি লগ্নি সংস্থার কাজকর্ম রুখে দেওয়ার মতো যথেষ্ট আইনি ক্ষমতা তাদের নেই।
সেবি-র সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই মনমোহন সরকার অর্ডিন্যান্স আনে তাদের আইনি ক্ষমতা বাড়াতে। মোদীর আমলে যার আইনও পাশ হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, বাড়তি ক্ষমতা পেয়েও কি তবে দায়িত্ব এড়াচ্ছে সেবি?
সেবি চেয়ারম্যান কিন্তু বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন অন্য ভাবে। তাঁর বক্তব্য, “দেশের কোনও প্রান্তে কোনও প্রতারক ১ কোটি, ২ কোটি বা ৫ কোটি টাকা তুললে তা সব সময়ে সেবি-র নজরে আসে না। এ ক্ষেত্রে রাজ্যগুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।”
তবে সারদার ক্ষেত্রে সেবি-কে ঘিরে প্রশ্ন কেবল এক্তিয়ার নিয়েই নয়। কারণ, বাম আমলেই সারদার কাজকর্মের কথা সেবি-কে জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে সারদার বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত নির্দেশ জারি করে সেবি। ফলে প্রশ্ন উঠছে, বাম আমলেই সারদার কাজকর্মের কথা সেবি জানতে পারা সত্ত্বেও কী ভাবে ওই লগ্নি সংস্থার এত বাড়বাড়ন্ত হল?
সেবি চেয়ারম্যান সিন্হা কিন্তু এ দিনও এর প্রাথমিক দায় চাপিয়েছেন রাজ্যেরই উপরে। সিন্হা জানান, কোনও বেআইনি লগ্নি সংস্থা বাজার থেকে ১০০ কোটির বেশি টাকা তুলে থাকলে সেবি-ই পদক্ষেপ করবে। রাজ্যগুলিকে এ ব্যাপারে তাঁরা সব রকম সাহায্য করবেন। কিন্তু কোনও প্রতারক এর চেয়ে কম অঙ্কের টাকা বাজার থেকে তুললে, রাজ্যগুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। রাজ্যগুলিই তাদের নিজেদের আইন করে প্রতারণা ঠেকাতে বা ব্যবস্থা নিতে পারে।