প্রতীকী ছবি।
শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না-করার নীতিতে অনড় তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। তবে রাজ্যে তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরে লগ্নি টানতে গোড়া থেকেই মাঠে নামার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। দাবি করেছে, সহজে ব্যবসার পরিবেশ তৈরি এবং প্রকল্প গড়ার প্রশাসনিক কাজে দ্রুত পদক্ষেপ করতে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কারণ, এই মুহূর্তে শিল্পায়নই তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তার প্রমাণ হিসেবে রাজ্য প্রশাসনের সদ্য নেওয়া দুই সিদ্ধান্তকেও তুলে ধরছে সরকারি মহল। যার একটি, গোটা পশ্চিমবঙ্গেই শিল্পতালুক গড়ার ক্ষেত্রে জমির ঊর্ধ্বসীমায় ছাড়। অন্যটি, জমি প্রদানকারীদের ক্ষতিপূরণ, জমি, বাড়ি ইত্যাদি দিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ কয়লাখনি, রাজ্যের ডেউচা পাঁচামিতে কাজ শুরুর বার্তা। সেই সঙ্গে ত্রাণ-পুনর্বাসন প্যাকেজ বাবদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক মূল্য বরাদ্দ করা। আর এই সব কিছুই হয়েছে এই দফায় তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বঙ্গের মসনদ দখলের পরে ১৫০ দিন পার হতে না হতেই।
সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, গত ১০ বছরের শাসনকালে শিল্পের তরফে যেমন বেশ কিছু ‘না-পাওয়ার’ অভিযোগ উঠেছে, তেমনই তার সঙ্গে একলপ্তে বেশি জমির অভাবও বড় বিনিয়োগের পথে বাধা হয়েছে। এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের দাবি, করোনায় ধাক্কা খাওয়া কর্মসংস্থানকে টেনে তুলতে শিল্পের প্রসার জরুরি বুঝেই দ্রুত লগ্নি-প্রস্তাব বাস্তবায়িত করতে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে রাজ্য শিল্প উন্নয়ন পর্ষদ। বিনিয়োগের পথে যাবতীয় সমস্যা দূর করাই হবে তার কাজ। কয়েকটি বৈঠকও করেছে পর্ষদ। ‘প্রথা মেনে’ ফেব্রুয়ারিতে (২২-২৪) বসবে বেঙ্গল গ্লোবাল বিজ়নেস সামিট। তার প্রস্তুতিও শুরু করেছে রাজ্য।
বিরোধীদের প্রশ্ন, প্রতি বার শিল্প সম্মেলনের পরে ঘটা করে বিপুল অঙ্কের লগ্নি আসার সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, বিভিন্ন সংস্থার বিনিয়োগের প্রথম ধাপ হিসেবে মোটা অঙ্কের সমঝোতা পত্র সইয়ের কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ছিটেফোঁটাটুকুই চোখে পড়ে।
রাজ্যের যদিও দাবি, শিল্পোন্নয়ন নিগম-সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে সংস্কার। জোর দেওয়া হচ্ছে ব্যবসার পরিবেশ সহজ করায়। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং নিগমের চেয়ারম্যান রাজীব সিংহ শিল্পমহলের সঙ্গে বৈঠক করছেন। পার্থবাবু জানিয়েছেন, রাজ্যে ল্যান্ডব্যাঙ্ক থেকে জমি নিয়ে লগ্নির আবেদন জানিয়েছে প্রায় ২৫টি সংস্থা।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র যে ‘ডেটা সেন্টার’ (তথ্যভান্ডার) নীতি তৈরির আর্জি জানিয়েছিল, তাতে সায় দিয়েছে রাজ্য। অন্য দিকে, প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য সম্প্রতি ভূমিপুজো করেছে ইনফোসিস। মাস দেড়েকের মধ্যে রাজ্যে অফিস চালু করবে মাইন্ডট্রি। একই ভাবে ইথানল-নীতি তৈরির পরে রাজ্যের দাবি, আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের ১৫টি প্রস্তাব রয়েছে রাজ্যের কাছে।
রাজ্যে তৃতীয় দফায় তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ইতিমধ্যেই পুরনো কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, বলছে প্রশাসনিক মহল। যেমন, পানাগড়ের শিল্পতালুকে ম্যাটিক্সের সার কারখানা চালু হয়েছে। সেটি অবশ্য বাম আমলেই শুরু হয়েছিলবলেদাবি বিরোধীদের। ২০২৪ সালের মধ্যে গেল-এর প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন নির্মাণে সাহায্যের জন্য জেলা প্রশাসনগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। অশোকনগরের পরে ওএনজিসি-কে উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলিতে তেলের সন্ধান চালাতেও ছাড়পত্র দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী।
উত্তরবঙ্গের ডাবগ্রাম শিল্পতালুকে ১৫ কোটি টাকার পাস্তা তৈরির কারখানা এবং ফুলবাড়িতে চারটি কারখানায় মোট ২৫ কোটি টাকা লগ্নি হয়েছে। উত্তরবঙ্গে চালু হয়েছে আরও প্রায় ২৫০টি ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি সংস্থা (এমএসএমই)। মালদহে
৫৫০ কোটি টাকার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং শিলিগুড়ির কাছে ফুলবাড়ি লাগোয়া ৭৫-১০০ কোটি টাকার পেপার মিল প্রকল্পও শুরুর মুখে। পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়ায় কিছু ছোট সংস্থা চালু হয়েছে। পুরুলিয়ায় চলতি অর্থবর্ষে ছোট শিল্পে লগ্নি এসেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার। উদ্যোগপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে মুর্শিদাবাদের প্রশাসন।
বিরোধীদের অভিযোগ, জমি জটের জন্যই বড় লগ্নি আসে না রাজ্যে। কিন্তু অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকারের বক্তব্য, ‘‘জমির সমস্যা এর কারণ নয়। বরং রাজ্যের ভাবমূর্তি নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। দ্বিধা থাকতে পারে কেন্দ্র-রাজ্যের সংঘাতের জন্যও। কারণ, প্রকল্পের অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ছাড়পত্রও লাগে।’’ যদিও তাঁর মতে, ‘‘অর্থনীতির নিরিখে বড় শিল্প জরুরি। কিন্তু তা বলে শেষ কথা নয়। চিন বা ইতালির মতো দক্ষ ছোট-মাঝারি শিল্প গড়ে আর্থিক অবস্থা ও কর্মসংস্থানে উন্নতি সম্ভব। তখন বড় শিল্পও আসবে।
শিল্পায়নের রথে সওয়ার হয়ে কাজ পেতে তরুণ প্রজন্মও রাজ্যের পদক্ষেপের ভরসায়। যেমন, পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ে শিল্পতালুকের প্রতিশ্রুতি থাকায় আইটিআই-তে ভর্তি হয়েছিলেন জিরাপাড়ার অদালিয়া গ্রামের উজ্জ্বল মাহাতো। বলছেন, ‘‘শিল্পের সম্ভাবনা কমতে থাকায় বাইরে কাজে চলে যাই। করোনার জন্য ফিরে আসতে হয়েছে। সরকার বহু দিন থেকে বলছে গোয়ালতোড়ে শিল্প হবে। এখনও শুনছি হবে! আশায় রয়েছি।’’
হাওড়ার ডোমজুড়ে রবার পার্ক, সাঁকরাইলের জরি হাব, রানিহাটির ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কও এখনও চালু হয়নি। পূর্ব বর্ধমানে বেশ ক’বছর আগে এমএসএমই শিল্পতালুকের দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্বোধন হলেও নতুন শিল্প আসেনি। মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘মিষ্টি হাব’। কাজ এগোয়নি বীরভূমে মেগা/মিনি ফুড পার্কের। তাই নতুনের সঙ্গে পুরনো প্রকল্পেরও চাকা গড়ানোর আশায় দিন গুনছেন রাজ্যবাসী।